শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

যেভাবে আমাদের উত্তম-সুচিত্রা

আলাউদ্দীন মাজিদ

যেভাবে আমাদের উত্তম-সুচিত্রা

‘তুমি যে আমার কবিতা, আমারও বাঁশির রাগিণী...’ কবরীকে নিয়ে গেয়ে উঠলেন নায়করাজ রাজ্জাক। দর্শক-শ্রোতার হৃদয়ে প্রেমের ঝড় তুলে দিলেন তাঁরা ‘দর্পচূর্ণ’ ছবির এই গান গেয়ে। তাই অবিসংবাদিতভাবে তাঁরা হয়ে গেলেন আমাদের উত্তম-সুচিত্রা।

রাজ্জাক-কবরী জুটি তৈরি হয়ে যেন ঢালিউডের ছবিতে এক নতুন যুগের সূচনা করল। এ নিয়ে নায়করাজ বলেছিলেন, ‘কবরী এসে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।’ অর্থাৎ রাজ্জাকের হিট ছবির তালিকা কবরীকে পেয়ে বেড়ে গেল অনেক। যদিও দুজন আলাদা নায়ক-নায়িকার সঙ্গেও হিট ছবি করেছেন। কিন্তু তাঁদের জুটি ছাপিয়ে গিয়েছিল সবাইকে। ওপার বাংলায় তখন উত্তম-সুচিত্রা জুটির সিনেমা তুমুল জনপ্রিয়। বাংলাদেশে তখনো তেমন কোনো জনপ্রিয় জুটি গড়ে ওঠেনি। রাজ্জাক ও কবরী তখন একক অভিনয়শিল্পী হিসেবে নিজ নিজ জায়গায় জনপ্রিয়তা কুড়াচ্ছেন। ১৯৬৮ সালে এই দুজনে প্রথম একসঙ্গে অভিনয় করলেন। ১৯৬৮ সালে সুভাষ দত্ত এ জুটিকে নিয়ে নির্মাণ করেন ‘আবির্ভাব’ চলচ্চিত্রটি। প্রথম ছবি দিয়েই বাজিমাত করেন তাঁরা। দর্শকের মনে জায়গা করে নেয় রাজ্জাক-কবরী জুটি। এরপর থেকেই তাঁরা জুটি বেঁধে উপহার দিয়েছেন ‘ময়নামতি’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘অধিকার’, ‘রংবাজ’সহ আরও অনেক দর্শকপ্রিয় ছবি। নায়ক রাজ্জাকের মতে, তখন থেকেই দেশের দর্শক তাঁদের উত্তম-সুচিত্রা জুটির বিকল্প হিসেবে আপন করে নেন। পরে রাজ্জাক-কবরী অভিনীত প্রায় সব সিনেমাই ছিল সুপারহিট। এভাবেই তাঁরা দুজনে দেশের সর্বকালের সেরা জুটির স্বীকৃতি পান। সাদা-কালো যুগে তাঁরা ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। ওপার বাংলার দর্শকপ্রিয় জুটির মতো এপার বাংলার মানুষ পেলেন জনপ্রিয় রাজ্জাক-কবরী জুটিকে।

 

প্রেমিক-প্রেমিকার আদর্শ ছিল এই জুটি

প্রেমিক-প্রেমিকাদের রোমান্টিসিজমের হাতেখড়ি শুরু হয় রাজ্জাক-কবরীর ছবি দেখার মাধ্যমে। ১৯৭৩ সালে ‘রংবাজ’ ছবির ‘হৈ হৈ হৈ রঙ্গিলা, রঙ্গিলা রে’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। শুরু হয় তাঁদের নিয়ে আলোচনা। ওপার বাংলার উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে নিয়ে যেমন আলোচনার ঝড় বইত, তেমন এপার বাংলাতেও রাজ্জাক-কবরীকে নিয়ে আলোচনার ঝড় শুরু হলো। রাজ্জাক-কবরী জুটি দর্শকদের সব সময় ভীষণভাবে টেনেছে। দর্শক তাঁদের কখনো পর্দায় নায়ক-নায়িকা মনে করেননি। সেই যুগের প্রেমিক-প্রেমিকারা এখনো ঋণ স্বীকার করেন তাঁদের কাছে। কারণ, পর্দার এ জুটি সিনেমার সংলাপ, গান, স্টাইলের বর্ণনা দিয়ে তাঁরা প্রেমপত্র লিখতেন। প্রেমিকযুগলের দেখা হলে আলোচনায় থাকত রাজ্জাক-কবরীর পর্দার প্রেম। তাঁরা গাইতেন সিনেমার গান। কখনো একসঙ্গে সিনেমা দেখতেন। দিন দিন তাঁরা ভক্তদের কাছে জীবন্ত হয়ে উঠেছিলেন। এ জুটির সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকারাও গেয়ে ওঠেছিল- ‘তুমি যে আমার কবিতা...।’

 

যেভাবে জনপ্রিয় জুটি

তাঁদের বিপুল এই জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে নায়ক রাজ্জাক এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, কবরীর সঙ্গে তাঁর জুটি গড়ে উঠেছিল ‘ময়নামতি’ সিনেমা দিয়ে। এটি ছিল একটি রোমান্টিক সিনেমা। সিনেমাটি দর্শক খুবই পছন্দ করেন। দর্শক চাহিদার কারণে পরে তাঁরা আবার একসঙ্গে অভিনয় করেন। সেটাও লুফে নেন দর্শক। একসময় তাঁরা বুঝতে পারেন, উত্তম-সুচিত্রার মতো তাঁদেরও জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সেই সাক্ষাৎকারে রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘আমাদের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠত গ্রামগঞ্জের ছেলেমেয়েদের আশা-আকাক্সক্ষা। আমরা সামাজিক গল্পে অভিনয় করতাম। পর্দায় আমাদের দেখলে দর্শক ভাবতেন, রাজ্জাক পাশের বাড়ির ছেলে আর কবরী পাশের বাড়ির মেয়ে। রাজ্জাকের মধ্য দিয়ে তরুণরা নিজেদের খুঁজে পেতেন। তরুণীরা নিজেদের কবরী ভাবতেন। আর আমি দেশের কোটি তরুণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারতাম বলেই হয়তো সব শ্রেণির দর্শক আমাদের আপন করে নিয়েছিলেন। তারা কখনো আমাদের ঘৃণা করতেন, কখনো ভালোবাসতেন, কখনো আমাদের জন্য কষ্ট পেতেন। এটিই ছিল আমাদের সাফল্য। ‘ময়নামতি’, ‘আবির্ভাব’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘বাঁশরী’, ‘রংবাজ’, ‘অধিকার’সহ আরও অনেক সিনেমা দিয়ে আমাদের জুটি পাকাপোক্ত হয়।

 

যেভাবে তাঁদের প্রথম দেখা

নায়করাজ রাজ্জাক ও কবরী দুজনই চলচ্চিত্রে কাজ করছেন। প্রথম দেখা প্রসঙ্গে কবরী বলেছিলেন, ‘‘রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা তখন আমি কিছুই ফিল করিনি। তখন রাজ্জাক সাহেব ওতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেননি। আমিও জনপ্রিয় হয়ে উঠিনি। রাজ্জাক সাহেব আগে থেকেই সিনেমায় কাজ করে আসছেন আর আমি ‘সুতরাং’ সিনেমার কাজ শেষ করেছি। গাজী মাজহারুল আনোয়ার ‘যোগাযোগ’ নামের একটি সিনেমা নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর বাসায় আমাকেও ডেকেছেন আর রাজ্জাক সাহেবকেও। সেদিনই আমাদের প্রথম সামনাসামনি কথা হয়। শেষ পর্যন্ত ওই সিনেমাটি আর নির্মাণ হয়নি।’’

 

যে পথে বন্ধুত্বের শুরু

সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কবরী বলেছিলেন, ‘ময়নামতি সিনেমার কাজের সময় আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। একে অপরের কাছ থেকে শিখেছি। আমরা নিজেদের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান করেছি। বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা এক্সচেঞ্জ করেছি। সিনেমার চরিত্র নিয়ে কথা বলেছি। সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছে। বিষয়টি এমন না যে, উনার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমার প্রেম হয়ে গেল। বরং কাজ করতে গিয়ে দুজনের মধ্যে দারুণ বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। দুজনই পেশাদারির সঙ্গে, ভক্তির সঙ্গে কাজ করেছি। এভাবেই অভিনেতা-অভিনেত্রী, বন্ধু হিসেবে ভালোবাসা  তৈরি হয়েছে। সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত একসঙ্গে কাজ করেছি। এর মধ্যে কত কথা হয়েছে। এর মধ্যে ভালোবাসা তৈরি হতেই পারে। আমরা শুধু জুটি হিসেবে সফল হয়েছি তা নয়, আমরা পেশাদার শিল্পী হিসেবেও স্বাক্ষর রাখতে পেরেছি।’

 

সবচেয়ে সফল জুটি

ষাটের দশক থেকে ঢাকাই ছবিতে এসেছে একের পর এক জনপ্রিয় জুটি। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে সফল রাজ্জাক-কবরী জুটি। বলা হয়, বাংলাদেশি সিনেমা জগতের নক্ষত্র প্রেম জুটি রাজ্জাক-কবরী। এ জুটির প্রেমের অনবদ্য উপস্থাপন দর্শকদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। এ জুটি অভিনীত জনপ্রিয় সব গান বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ধ্রুপদি গানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। পর্দার রসায়নের বাইরে রাজ্জাক-কবরীর প্রেম নিয়েও গল্প-গুজবের অভাব ছিল না। রাজ্জাক-কবরী সিনেমার অবিচ্ছেদ্য জুটি যেমন ছিলেন, তেমনি তাদের মধ্যে ঝগড়াও লেগে থাকত। এসব নিয়ে মান-অভিমানও নাকি তৈরি হতো। নিজের ৭৬তম জন্মদিনের প্রারম্ভে ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় গুলশানে নিজের বাসভবন ‘রাজলক্ষ্মী’তে বসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের ছলে কবরীর সঙ্গে ‘প্রেমকথা’ নিয়ে মুখ খুলেছিলেন প্রয়াত নায়করাজ রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘তোমাদের মা-খালাদের কাছে প্রশ্ন করো যে রাজ্জাক-কবরী সম্পর্কে কিছু বলো। তারা দেখবে ফিসফিস করে বলছে, ওহ বাবা! সে কী প্রেম। আসলে আমার আর কবরীর পর্দার প্রেমটাকে সবাই এতটাই ভালোবেসেছিল।’ রাজ্জাক-কবরী দুজনই এখন প্রয়াত। কিন্তু যতদিন বাংলা চলচ্চিত্র থাকবে ততদিন দর্শকদের কাছে অমর হয়েই থাকবে এ জুটি।

 

‘ময়নামতি’ ছিল টার্নিং পয়েন্ট

কাজী জহির নির্মিত ‘ময়নামতি’ সিনেমা মুক্তির পর এই জটি বুঝতে পারে, জনপ্রিয়তা কাকে বলে। যেখানেই যেতেন, সবার মুখে শুনতেন রাজ্জাক-কবরী জুটির আরও সিনেমা চাই। দেশের সর্বকালের সেরা জুটি প্রসঙ্গে রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার আগে থেকে আমরা অনেক সিনেমায় একসঙ্গে কাজ করেছি। পরে শুনতাম, আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জুটি। কীভাবে মানুষের এতটা ভালোবাসা পেয়েছি, জানি না। তবে আমরা অভিনয়ের জন্য নিবেদিত। আমাদের বোঝাপড়া ভালো ছিল। হয়তো পর্দায় বিপুলসংখ্যক মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছি।’ রাজ্জাকের বক্তব্যের সুরেই কবরী বলেছিলেন, ‘পর্দায় আমার আচার-আচরণ, বাচনভঙ্গি, লুকিয়ে কান্না করা, চাহনি, ডায়ালগ বলার ধরন, হাসি, সাধারণ গেটআপ, একদমই পাশের বাড়ির মেয়ের মতো ছিল। যেখানে যেতাম, দর্শক এটাই বলতেন। একজন মা-বাবা ভাবতেন তাঁদের মেয়ে। এটাই আমার সফলতা।’

সর্বশেষ খবর