বুধবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

পঙ্কজ উদাসের পাঁচ গানের মজার গল্প

পঙ্কজ উদাসের পাঁচ গানের মজার গল্প

ওপারের চিঠির ডাকে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে গেলেন ‘চিঠির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর’ খ্যাত জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী পঙ্কজ উদাস। তার দীর্ঘ সংগীতজীবনে তারই পছন্দের সেরা পাঁচ গানের গল্প বলেছিলেন পঙ্কজ উদাস জীবদ্দশায় নিজেই। কলকাতার পাঠকপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ‘আনন্দবাজার’ অবলম্বনে সেই গল্পগুলো তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

‘চিঠি আইয়ি হ্যায়...’

চিঠি নয় ফোন এসেছিল সেদিন আমার কাছে। আজ মনে হয় ওই ফোনটাই বদলে দিল আমার জীবন। ফোনের ওপার থেকে বলা হলো- ‘আমি রাজেন্দ্র কুমার বলছি। আমি চাই ‘নাম’ ছবিতে তুমি অভিনয় কর।’ তত দিনে ‘মুকারার’, ‘তরন্নাম’-এর মতো আমার গজলের অ্যালবাম দেশ-বিদেশে সাড়া ফেলেছে। বিদেশেও গজলের কয়েকটা অনুষ্ঠান হয়ে গেছে। এরকম অবস্থায় হঠাৎ অভিনয় করতে যাব কেন আমি? ওটা তো আমার জায়গা নয়। কিন্তু মুখের ওপর রাজেন্দ্র কুমারের মতো মানুষকে ‘না’ বলার সাহস পাইনি। অবস্থা সামাল দিতে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। আর তাতেই চটে গেলেন রাজেন্দ্র কুমার। আমার ভাই মনহর উদাসের কাছে ফোন গেল-‘তুমহারা ভাই তো বহত বদ তমিজ হ্যায়!’ ভুল বোঝাবুঝির অবসান হলো। অনেক সাহস সঞ্চয় করে রাজেন্দ্র কুমারকে অভিনয় না করার কারণটা বুঝিয়ে বলতে পেরেছিলাম। বুঝলাম রাজেন্দ্র কুমার ছবিতে আমাকে দিয়ে লাইভ গাওয়াতে চান। পাঁচটা সিটিংয়ে লেখা হলো ৭ মিনিটের গান। মনে আছে আনন্দ বক্সীজি খুব সুন্দর বলেছিলেন, ‘আমাকে গান নয়, লিখতে হবে চিঠি। যাতে থাকবে ঘরে ফেরার সুর।’ লেখা হলো ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়। বতনসে চিটঠি আয়ি হ্যায়। বড়ে  দিনো কে বাদ হম বেওয়াতনকো ইয়াদ। ওয়াতন কি মিট্টি আয়ি হ্যায়।’ তখন ফেসবুক বা স্কাইপ কিছুই ছিল না। প্রবাসের সঙ্গে দেশের সংযোগের মাধ্যম ছিল এ গান। দেশের জন্য মন খারাপ হলে এ গানের সুরই প্রবাসের সেই মানুষগুলোর সঙ্গে তাদের প্রিয়জনদের বেঁধে দিত। এভাবেই ৩৫টি বছর পেরিয়ে গেল। আজ খুব মনে পড়ছে চিঠি শুরুর সেই সময়। এত বছর পর ফিরে তাকালে মনে হয় ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’-এর হাত ধরে নামি-অনামি কত মানুষের কাছে আমি পৌঁছতে পেরেছি। এ গান থেকে এ জন্মে যেন পঙ্কজ উদাসের মুক্তি নেই। সেই ‘চিঠি’র বয়স এখন তিরিশ। কিন্তু তার রেকর্ডিং সহজ ছিল না। ‘নাম’ ছবির সেই দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল মুম্বাইতে। লাইভ কনসার্টের পরিবেশ তৈরি করে ৬০ জন মিউজিশিয়ানের সঙ্গে এক টেকেই ওকে হয়েছিল ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’। তখন লাইভ গাইতে হতো। গানটা যত চড়া পর্দায় খেলে, ততটাই নিচের দিকেও যায়। সে কী টেনশন আমার! আমি তো রেকর্ডিং শেষ হওয়ার পর ভেবেছিলাম আবার গাইতে হবে। হঠাৎ দেখি লক্ষ্মীকান্তের স্ত্রী গানটা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আর লক্ষ্মীকান্ত বললেন, ‘এ গান অনেক দূর যাবে।’ এই তো সেদিন দিল্লির এক কনসার্টে একটি ছেলে আমার হাত ধরে কেঁদে ফেলল। একটু আগেই নাকি স্কাইপে মায়ের সঙ্গে ভোপালে কথা বলেছে সে। বলল, ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’ শুনে মনে হলো আমার মা-বাবার কথা সামনে শুনছি...। এমন অনুষ্ঠান আমার মনে পড়ে না, যেখানে ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’ গাইতে হয় না। মঞ্চ থেকে দেখি চিঠির সুরে অজস্র মানুষের চোখে জল। কোনো মা বিদেশে পড়তে যাওয়া ছেলের জন্য কেঁদে ফেলছেন, কেউবা সুরের মধ্যে নিজের ভালোবাসার মানুষকে দেখতে পাচ্ছেন।

 

এ গান শুনে কেঁদেছিলেন রাজকাপুর

‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’ গান শুনে কেঁদেছিলেন রাজকাপুরও। ১৯৮৬ সালে ‘নাম’ ছবিতে ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’ গান গেয়ে সবার মন জয় করে নেন।  ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’ গান শুনে যেভাবে কেঁদেছিলেন রাজকাপুর তার একটি বর্ণনাও রয়েছে। রাজকাপুর আর রাজেন্দ্র কুমার ছিলেন খুব ভালো বন্ধু। গান তৈরির কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর একদিন রাজকাপুরকে রাজেন্দ্র কুমার তার বাড়িতে নৈশভোজের নিমন্ত্রণ জানালেন। খাওয়া-দাওয়ার পর ‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’ শোনালেন বন্ধুকে। ন্যারেশন শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন রাজ! একা রাজ কাঁদেননি। এ গানে কেঁদেছিল গোটা দেশ। হলে ‘নাম’ ছবির প্রতিটি শো-এ প্রায় একই দৃশ্য। সেই গল্প পঙ্কজকে বলেছিলেন তার মা জিতু বেন। 

 

‘জিয়ে তো জিয়ে ক্যায়সে বিন আপকে’

‘চিটঠি আয়ি হ্যায়’-এর প্রবল জনপ্রিয়তার পর ইন্ডাস্ট্রিতে রটে যায় যে-ছবিতে পঙ্কজ উদাসের গানের লাইভ দৃশ্য থাকবে সেই ছবি সুপারহিট। ভিতর থেকে কোনো গান ভাবিয়ে না তুললে সেটা কখনোই কিন্তু রেকর্ড করতাম না। হঠাৎই এক দিন সমীরের লেখা একটি গান নজরে এলো। ‘সাজন’ ছবিতে ‘জিয়ে তো জিয়ে ক্যায়সে বিন আপকে’ গানটির কথার জন্য গেয়ে ফেললাম। শুট হলো, সঙ্গে মাধুরী দীক্ষিত, সঞ্জয় দত্ত, সলমন খান। আমার গান শুনে দেখি মাধুরীও গেয়ে উঠছে। অনেকেই জানে না, ও অসম্ভব ভালো গায়। শুট চলাকালীন একটা মজার ঘটনা। গানটা শুট হওয়ার পর সলমন হঠাৎই বলে উঠল, ‘বাঃ পঙ্কজ ভাই বাঃ!’ ক্যামেরা তখনো অন। চিত্রনাট্যে কোথাও এ সংলাপ ছিল না। কিন্তু সলমন এত স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলেছিল যে, সংলাপটি রেখে দেওয়া হলো। আজও অনুষ্ঠানে গিয়ে এ গানটা আমাকে গাইতেই হয়। আর দর্শকের মাঝখান থেকে কেউ না কেউ বলবেই, ‘বাঃ পঙ্কজ ভাই বাঃ!’

 

‘চাঁদি জ্যায়সা রং’...

প্রেমের গান গাইতে গাইতে অনেকের কাছেই গায়কেরা অদৃশ্য প্রেমিক হয়ে যায়। ভালোবাসার রঙিন খামে আজও প্রচুর চিঠি এসে পৌঁছায় আমার কাছে। আসে হোয়াটসঅ্যাপ ইমেইলে প্রেমের বার্তা। জানি এ ভালোবাসা আমার গানের জন্য। আমার জন্য নয়। আমিও এক সময় প্রেমে  পড়েছি, গেয়ে উঠেছি ‘চাঁদি জ্যায়সা রং’। কত লোকে বলেছে আমায়, এ গান শুনিয়ে বা গেয়ে তারা প্রথম প্রেমের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। এ গান তো অনুষ্ঠানে আমাকে গাইতেই হয়। আর গাওয়ার আগে বলে নিই, প্রেমিকা যদি রেগে থাকেন এ গান শোনার পর আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি অন্তত সাত দিনের জন্য তিনি রাগবেন না। আমার তো মনে হয় এ গান প্রেমের চিরকালীন ন্যাশনাল অ্যানথেম।

 

‘অউর আহিস্তা কি জে বাতে’...

আমার তো মনে হয় ভালোবাসার কোনো সীমানা নেই, নেই কোনো ভাষাও। সে কারণে ‘অউর আহিস্তা কি জে বাতে’র ভিডিও শুটে একজন অস্ট্রেলিয়ান ছেলের সঙ্গে ভারতীয় মহিলার প্রেমকাহিনি বলা হয়েছিল। আমার রোমান্স বৃষ্টির সঙ্গে। কেবলই খুঁজি বৃষ্টিকে। বৃষ্টি  আমাকে দিয়ে গান গাইয়ে নেয়। সময় পেলে ‘আরজু’ দেখতে বসে যাই। অভিনেত্রী সাধনা আমার খুব প্রিয়।

 

‘দিওয়ারো সে মিলকর রোনা আচ্ছা লগতা হ্যায়’...

একবার গজল ফেস্টিভ্যালে গাইছি, ‘দুনিয়া ভর কি ইয়াদেঁ হমসে মিলনে আতি হ্যায়। শাম ঢলে ইস সুনে ঘরমে মেলা লগতা হ্যায়। হম ভি পাগল হো জায়েঙ্গে অ্যায়সা লগতা হ্যায়। দিওয়ারো সে মিলকর রোনা আচ্ছা লগতা হ্যায়।’ খবর এলো আমার বাবা আর কিছুক্ষণ আছে। সেদিনও গান বন্ধ করতে পারিনি। গান শেষ করেই ছুটে যাই হাসপাতালে। শেষবার দেখেছিলাম বাবাকে... এখনো এ গান গাইতে গেলে বাবাকে দেখি...। প্রেমের গান কখন যেন মৃত্যুতে এসে দাঁড়ায়, আবার ফিরিয়েও নিয়ে যায় প্রেমে।

সর্বশেষ খবর