শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

এক বর্ণাঢ্য জীবনের বিষাদ অবসান...

এক বর্ণাঢ্য জীবনের বিষাদ অবসান...

কিংবদন্তি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও সুরকার সাদি মহম্মদ। রবীন্দ্রসংগীতের ওপর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করা এ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মূল পরিচিতি রবীন্দ্রসংগীতে গড়ে উঠলেও আধুনিক গানেও ছিল সমান পারদর্শী।  এ প্রখ্যাত শিল্পী মাত্র ৬৯ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন বুধবার সন্ধ্যায়। তার এ স্বেচ্ছামৃত্যু কি অভিমান-বিষণ্নতায় নাকি অন্য কোনো কারণে? তাকে নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রসংগীতে পড়াশোনা করা প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদের বাবা শহীদ সলিমউল্লাহ। ১৯৭১ সালে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের সি-১২/১০ বাড়িটি ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা সলিমউল্লাহর বাড়িতে নিয়মিত বৈঠকে আসতেন দলের শীর্ষ নেতারা, আসতেন বঙ্গবন্ধুপুত্র শহীদ শেখ কামালও। একাত্তরের ২৩ মার্চ তাজমহল রোডের সেই বাড়িতে সেজ ছেলে সাদি মহম্মদ তকিউল্লাহর আঁকা বাংলাদেশের পতাকা উড়ান বাবা সলিমউল্লাহ, সেই পতাকা সেলাই করে দিয়েছিলেন সাদি-শিবলীর মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ। সেই পতাকা উড়ানোর সূত্র ধরে একাত্তরের ২৬ মার্চ অবাঙালি বিহারি ও পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে সলিমউল্লাহর বাড়ি। পুড়িয়ে দেওয়া হয় পুরো বাড়ি, গুলি করে মারা হয় সলিমউল্লাহকে। গত বছরের ৮ জুলাই ৯৬ বছর বয়সে মারা যান তার মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ। মায়ের মৃত্যুর পর সাদি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তার মা ৭১ সালের ২৬ মার্চের সেই ভয়াল রাতে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য সন্তানদের নিয়ে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাড়ির দোতলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়েন। সেদিন থেকে দুটো পা ভেঙে অকেজো হয়। এরপর লম্বা সময় ক্র্যাচ এবং শেষ ১৫ বছর হুইল চেয়ারে জীবন কাটিয়েছেন একই বাড়িতে। সেই মাকে হারানোর ব্যথা বুকে চেপে একই বাড়িতে বেছে নেন স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ। মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা করে গায়কের ভাই নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ বলেন, ‘মৃত্যুর দিনও তানপুরা নিয়ে সংগীতচর্চা করেছেন। সন্ধ্যার পর হঠাৎ দেখা যায় তার ঘরের দরজা বন্ধ। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আমরা দরজা ভেঙে ফেলি। তখন দেখতে পাই তার ঝুলন্ত মরদেহ।’ সাদি মহম্মদের ব্যক্তিগত সহকারী জানান, ‘বেগুনি-মুড়ি দিয়ে ইফতার শেষে নিজ রুমে যান তিনি। বেশ কিছুক্ষণ রেয়াজ করেন তানপুরা নিয়ে। যেটা তিনি প্রায় সময় করে থাকেন। এরপর অনেক সময় চুপচাপ থাকেন। এ সময় পরিবারের সদস্যরা ডাকাডাকি করলে সাড়া মিলছিল না। তারা গিয়ে দেখেন দরজা বন্ধ। পরে দরজা ভেঙে সাদিকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেন তারা।’ সাদি মহম্মদের মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নীপা বলেন, ‘ওনার মা মারা যাওয়ার পর থেকেই একটা ট্রমার মধ্যে চলে যান। ঠিক স্বাভাবিক ছিলেন না মানসিকভাবে। মা হারানোর বেদনা সম্ভবত তিনি নিতে পারেননি। এভাবেই চলছিল। বুধবার রোজা রাখলেন। ইফতারও করলেন। এরপরই তিনি নীরবে না ফেরার দেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে করছি।’ তবে তার মৃত্যুর বিষয়ে কিছু প্রিয় মানুষ ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী অনিমা রায় ক্ষোভ নিয়ে জানান, ‘একজন মানুষ সাদি মহম্মদ হয়ে ওঠলেন, এখনো জাতীয় কোনো পুরস্কার পাননি। এটা কি মানা যায়? রবীন্দ্রসংগীত জগতে যে মানুষটার এত অবদান, এত এত শিল্পী যিনি তৈরি করেছেন তার কোনো স্বীকৃতি নেই! স্বীকৃতি শুধু সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। তাহলে বাকিদের সঙ্গে তার তুলনা কেন? কেন সাদি মহম্মদের মতো মানুষকে খুঁজে নিয়ে আসতে হবে? যে মানুষকে সবাই চেনে? এ অভিমান স্যারের বুকভরা ছিল।’ একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদ। তিনি ফেসবুক পোস্টে লিখেন- ‘কী ২১ শে পদক? কেমন লাগে তোমার? সাদি মহম্মদ গেলেন? চলেই গেলেন। ক্ষমা করেন সাদি ভাই। বেঁচে থাকতে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানগুলোকে আমাদের চেনা হয়ে ওঠে না। তাদের প্রাপ্যটা আমরা এভাবেই দেই...বেঁচে থাকতেই সাদি ভাই বলে গেছেন- ‘আমাকে যেন কোনো মরণোত্তর পদক না দেওয়া হয়।’ এদিকে শিল্পী শাহীন সামাদ শোকার্ত হয়ে ফেসবুকে লেখেন- ‘সাদি আর আমাদের মাঝে নেই, বিশ্বাস করতে পারছি না। কতদিনের গানের সাথী। কত অনুষ্ঠান করেছি তার ঠিক নেই। দেখা হলেই হাসিমুখে বলত শাহীন আপা কেমন আছো? সংগীতজগতে তোমার অবদান শ্রোতা-ভক্তরা আজীবন মনে রাখবেন।’ আরেক সংগীতজ্ঞ সুজিত মোস্তফাও লেখেন- ‘সাদি মহম্মদ ভাই বা আমাদের প্রিয় সাদি ভাই, কাজটা একদম ঠিক করলেন না। আপনাকে কত মানুষ ভালোবাসে আপনি জানেন? আমাকে যতটা ভালোবাসা দিয়েছেন হয়তো বুঝতে পারেননি আপনাকে আমি তার চেয়েও বেশি ভালোবাসতাম। আপনিতো জানেন এখানে অভিমানের দাম নেই, তাই অভিমান করা তো বোকামি বই আর কিছু নয়। ওপারে ভালো থাকুন সাদি ভাই, আমাদের ভালোবাসায় থাকুন।’ সেদিন হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন অভিনেতা ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সাদি ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে আমি এক কথায় বিধ্বস্ত।

১৯৬৮ সাল থেকে ওনাদের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক। তিনি এত ভালো মানুষ ছিলেন যে রাগ করেও কাউকে কিছু বলেছেন এমনটা কখনোই দেখিনি। এত বড় একজন শিল্পী কিন্তু তার মধ্যে কোনো অহমিকা ছিল না। তিনি আজ চলে গেলেন। আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করি।’ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও চলচ্চিত্র পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেছেন, ‘আমাদের কাম্য ছিল না এটা। আমরা কখনো ভাবিনি সাদি মহম্মদ এভাবে চলে যাবে। তার এ চলে যাওয়ায় আমরা আতঙ্কিত ও শোকাহত। তার মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তার সেই ভরা গলা, দরাজ কণ্ঠের গান আর কোথায় পাব? কত দিন অপেক্ষা করতে হবে?’ প্রখ্যাত শিল্পী সাদি মহম্মদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে শহীদ পিতার সন্তান। তার বাবার নাম শহীদ সলিমউল্লাহ। মায়ের নাম জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ। বাবা-মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী ১৯৭৩ সালে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন সাদি মহম্মদ। তবে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মন বসাতে পারেননি তিনি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালীন ১৯৭৫ সালে স্কলারশিপ নিয়ে শান্তিনিকেতনে সংগীত নিয়ে পড়তে যান। বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রসংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। সেই থেকে শুরু পথচলা।

‘ওনার মা মারা যাওয়ার পর থেকেই একটা ট্রমার মধ্যে চলে যান। ঠিক স্বাভাবিক ছিলেন না মানসিকভাবে। মা হারানোর বেদনা সম্ভবত তিনি নিতে পারেননি। এভাবেই চলছিল। বুধবার রোজা রাখলেন। ইফতারও করলেন। এরপরই তিনি নীরবে না ফেরার দেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে করছি’

শামীম আরা নীপা

সাদি মহম্মদ ২০০৭ সালে ‘আমাকে খুঁজে পাবে ভোরের শিশিরে’ অ্যালবামের মাধ্যমে সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২০০৯ সালে তার শ্রাবণ আকাশে ও ২০১২ সালে তার সার্থক জনম আমার অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এ ছাড়াও তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠন রবিরাগের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হত্যা করে তার বাবা সলিমউল্লাহকে। তার বাবার নামে ঢাকার মোহাম্মদপুরের সলিমউল্লাহ রোডের নামকরণ করা হয়। সাদি মহম্মদের ছোট ভাই শিবলী মহম্মদ বাংলাদেশের একজন নৃত্যশিল্পী। একুশে পদক না পেলেও তিনি ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার।

মা-বাবার পাশে দাফন : গতকাল বিকালে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সাদি মহম্মদ। এর আগে বাসার নিচে স্বজনদের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মোহাম্মদপুর জামে মসজিদে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

সর্বশেষ খবর