শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা
বিশেষ সাক্ষাৎকার : ফাহমিদা নবী

স্বপ্ন ছাড়া তারুণ্য বেঁচে থাকে না

চোখের তারায় মায়াবী ছায়া, মুখে সদা হাসি লেগেই থাকে। তাকে গান গাইতে দেখা যায় ছিমছাম সাজে। প্রায়ই কানের পাশে শোভা পায় চুলের ভাঁজে গুঁজে রাখা টাটকা লাল ফুল যেটি ছিমছাম সাজটিকেই করে তোলে অসাধারণ। আমাদের গানের ভুবনে এমন গায়িকা একজনই আছেন; তিনি প্রিয় ফাহমিদা নবী। যিনি লুকোচুরি লুকোচুরি গল্পে আমাদের আবেগী এক নদীতে ভেসে নিয়ে যান ইচ্ছার মেঘলা আকাশে। গানের কথার মতো সুরটাও উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া। এই গুণী সংগীত তারকার সঙ্গে আলাপচারিতা তুলে ধরেছেন- পান্থ আফজাল

স্বপ্ন ছাড়া তারুণ্য বেঁচে থাকে না

সামাজিক মাধ্যম একটা স্বাধীন জায়গা। এখানে বন্ধ করার মতো কিছু নেই। এখানে অনেক কিছু দেখে চুপ হয়ে যেতে হয়।  এটাও কিন্তু একটা প্রতিবাদ। আত্মোপলব্ধির জায়গাটাই তো নেই। সবাই এখন সেলিব্রেটি...

 

গান করেন, লেখেন আবার সেটিতে সুরও করেন। এ ছাড়াও উপস্থাপনায় অনবদ্য। এত গুণের রহস্য কী?

কোনো রহস্য নেই। উপস্থাপনা আসলে আমি গানের কিছু প্রোগ্রাম করেছি। সেগুলো তো উপস্থাপনা করেছি এবং বড় বড় কিছু শিল্পীর ইন্টারভিউ নিয়েছি। লিখেছিও। যেহেতু আমি একটু-আধটু লেখালেখিও করি। অভ্যাস আছে লেখালেখির। তো সেখান থেকে আরকি লেখা হয়েছে। তবে গানের অনুষ্ঠান করেছি বেশ অনেকদিন ধরেই।

 

এত ব্যস্ততার পরও ব্যস্ততাটা কী নিয়ে?

আমাদের ব্যস্ততা তো গানকে ঘিরেই। জীবন যখন যেমন। এই আরকি! তবে হয়েছে কি এখন নতুন গান দিতে ইচ্ছা করে না। কেউ যদি গান করায় তখন ভাবি যে কী গান করব! গানের কথা ঠিক আছে কি না, সুর ঠিক আছে কি না। তার পরও গান করি, যদি সবকিছু মনের মতো হয় তাহলে।

 

আপনি কোনো এক প্রসঙ্গে বলেছেন গান করতে ভয় করে, কারণ কী?

ভয় করে এই কারণে আমরা যেভাবে বড় হয়েছি, যেভাবে গানের জগৎকে দেখেছি, চিনেছি-বুঝেছি; উপলব্ধি সবচেয়ে বড় বিষয়। আমি মনে করি গান হলো আমি যে গানটি করব সে গান শুনে শ্রোতা দুঃখ বা সুখে চলে যাবে। এটাই হলো নিয়ম। যারা গান করে তাদের এটাই নিয়ম। আমি বড় হয়েছি বাবাকে দেখে যে গান করবে, অর্থবহ হবে। কিন্তু এখন সবাই গান করতে চায় টিকটকের জন্য, স্টেজে পারফরমেন্সের জন্য। স্টেজ, টিকটক এগুলো এমন একটা গোলকধাঁধার মতো, এটা কেমন যেন একটা অস্থিরতা! গানের সঙ্গে আসলে অস্থিরতা নেই। সে জন্যই ভয় লাগে যে আমার গান তো আসলে ভাইরাল হবে না। তো আমি কী গান করব? ভাবতে হয় এগুলো। তবে একটা সুন্দর উপলব্ধি আছে আমার যে, যখন এমন অস্থিরতা যায় ততই আমি আরও বেঁকে বসি। আমি ভাবি আমি যেখানে ছিলাম আমাকে সেখানেই থাকতে হবে। কারণ যখন চলে যাব আমার গান, আমার কথা, আমার জাগতিক জীবনে এই চলাফেরা-সবকিছু মানুষকে স্মরণীয় একটা আবর্তে রাখবে।

 

তরুণ প্রজন্ম ভাইরালের জন্য গান করছে?

আমি মনে করি, তা নয়। অনেকেই আসে। কোথা থেকে আসে কীভাবে আসে আমি জানি না। কিন্তু তারা জীবিকার সঙ্গে সংগীতটাকে রিলেটেড করে ফেলেছে। যেখানেই যাই না কেন মানুষ তো এখন আর গান শুনতে চায় না, নাচতে চায়। তো আমি নাচানোর জন্য গান করব। সুরও শুনতে চায় না। কী গান গাইছে সেটা নিয়েও ভাবছে না কেউ। তবে যারা ভাইরাল হওয়ার জন্য করছে তারা অনেকেই সংগীতশিল্পী না। মিডিয়া একটা বিশাল জায়গা যেখানে চাইলে সহজেই অনেক কিছু করা যায়। সেখানে তারা গান করে নাকি অভিনয় করে, নাকি নাচ করে সেটা কোনো বিষয় নয়। আমি যখন গান করি তখন ভাবি এই গানটা শ্রোতাদের কাছে কতটা শ্রুতিমধুর লাগবে। কীভাবে পৌঁছাল বা কী বার্তা আছে গানটার মধ্যে। সেগুলো নিয়েই ভাবি আমি।

 

গানের জগতে এমন অস্থিরতার কারণে প্রকৃত শিল্পীরা সমস্যায় পড়ছেন কি?

পড়ছেই তো। এটা তো যুগে যুগে একটা নিয়মের মধ্যে পড়ে। বয়স তো একটা সংখ্যা মাত্র। যার যেখান থেকে শুরু সেখানে তার অভিজ্ঞতাই শুধু একটি বাক্সে জমা হতে থাকে। সেই অভিজ্ঞতাকে নিয়েই সে একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে। এটাই নিয়ম। আর যারা তাকে অনুসরণ করে চলবে, তারাই কাজ করতে থাকবে এবং যে অভিজ্ঞতা একটা জায়গায় দাঁড়াল তাকে সেই সম্মানের জায়গাটা দেওয়া দরকার। কিন্তু এখন তো পুরো উল্টো হচ্ছে। এটা এখন সঠিক করা তো অনেক কঠিন ব্যাপার। এখানে কেউ কাউকে দোষারোপের কিছু নেই। যে যেভাবে সুযোগ পাচ্ছে ঢুকে যাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যম এক্ষেত্রে অনেক পাওয়ারফুল জায়গা। এখানে যে কেউ নিজেকে এক্সপ্রেস করতে পারছে। নিজেকে মেলে ধরতে পারছে। সেখান থেকে কেউ যদি কাউকে পিক করে এবং পিক করার পর সেই ফেসবুক শিল্পী যদি নিজেকে বিশাল কিছু ভাবে, সেটা তো কারও কিছু করার নেই। এটা একটা স্বাধীন জায়গা। এখানে বন্ধ করার মতো কিছু নেই। এখানে অনেক কিছু দেখে চুপ হয়ে যেতে হয়। এটাও কিন্তু একটা প্রতিবাদ। আত্মোপলব্ধির জায়গাটাই তো  নেই। সবাই এখন সেলিব্রেটি।

 

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি, পরিবারের সবাই কেমন আছে?

সবাই ভালো আছেন। সামিনা অনেক ভালো আছে। আমার ছোট বোন সে অবশ্য আর্টিস্ট; ছবি আঁকে। বিদেশে থাকে। সে ক্যালিগ্রাফি নিয়ে খুবই ব্যস্ত। আর আমার ভাই পঞ্চম চাকরি করে পাশাপাশি যখন তার মন চায় তখন মিউজিক করে। এমনিতেই মিউজিক নিয়েই সারাক্ষণ থাকে। তবে এই অঙ্গনে এখন তার চলাফেরাটা একটু কম। ওর অনেক ভক্তকুল কিন্তু সে সামনে আসতে চায় না এখন কারণ এত অস্থিরতায় ও অভ্যস্ত নয়। মানিয়ে নিতে পারে না। যেমন আমিও পারি না। মানিয়ে নেওয়া না নয়, মানানসই হতে পারছি না আর কি!

 

বাবার আদর্শের সঙ্গে, শিক্ষার সঙ্গে এখনকার অস্থির সময়ে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে বলেই কি এই মন্তব্য করছেন?

আসলে যা শিখেছি সেটাই আমার চোখ দেখে। আমি আসলে আবার নতুন করে কিছু দেখতে পাই না। এটা কেন হয় আমি ঠিক জানি না। তবে ভালো কিছুর দিকেই চোখ চলে যায়। খারাপ কিছু দেখলে সেখানে আমার চোখ যায় না। আমার মনে হয় এটা আমার মায়ের বিশাল শিক্ষা। খারাপের দিকে কখনোই তাকিও না। ভালোই দেখ। তাহলে দিনশেষে ভালোর ভালো হয়, মন্দের মন্দ হয়। আর আমার বর্তমানে যেটা অনুধাবন, আমার কোনো এক্সপেকটেশন নাই। একদম না। সবকিছুতেই, প্রফেশনালেও। তবে এক্সপেকটেশন একটা জায়গায় থাকতেই হয়। সেটা হচ্ছে স্বপ্ন। সেই স্বপ্লের এক্সপেকটেশন না থাকলে তো কেউ এগোতে পারবে না। স্বপ্ন ছাড়া তারুণ্য বেঁচে থাকে না। মৃত্যুটাও সত্য হয় না।

 

আপনার গানগুলো একটু অন্যরকম...

হ্যাঁ, একটু গল্পের মতো। মনে করো ৫ মিনিটের একটা সিনেমা। তো সেখানে গানের মুখ আছে, প্রেম হলো। তারপরে কী হলো। তারপরে অনেক আনন্দ করল। তারপর একসময় গিয়ে তাদের ব্র্রেকআপ হয়ে গেল। তারপরে যদি এমন হতো....। মানুষের জীবনটা আসলে মরীচিকার মতো। মরীচিকার পেছনেই সবাই ছুটতে থাকে। সেটা না থাকলেও সমস্যা আবার থাকলেও সমস্যা। তো নিজেকে আসলে গুছিয়ে নেওয়ার যে গল্পটা সে গল্পটা আমার গানে থাকে। আমার আসলে কিছু করার নাই। আমার গানগুলো শুনতে ভালো লাগে, গাইতে গেলে অনেক হৃদয় দিয়ে ভেতর থেকে স্পষ্ট উচ্চারণে গাইতে হয়।

 

 

সর্বশেষ খবর