শিরোনাম
রবিবার, ১২ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা
মা দিবস উপলক্ষে বিশেষ সাক্ষাৎকার

মা আছেন সমস্ত সত্তাজুড়েই

মা আছেন সমস্ত সত্তাজুড়েই

বয়স ৮১, তাতে কি! তিনি বারবার বয়সের অঙ্ককে তুড়ি মেরে বাউন্ডারি হাঁকাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে তো গেটআপ-মেকআপে ষোড়শী তরুণী প্রচ্ছদ কন্যারূপে নিজেকে উপস্থাপন করে চমকে দিচ্ছেন। যিনি মা চরিত্রে অনবদ্য ও অসাধারণ। অভিনয় মিশে আছে যার রক্তে। তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী কিংবদন্তি অভিনেত্রী দিলারা জামান।  আজ মা দিবসে এ মমতাময়ী মায়ের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলেছেন-  পান্থ আফজাল

 

আজ মা দিবস। দিবসটি নিয়ে কিছু বলবেন কি?

না, আমি চিরজীবনই বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালি মানসিকতা, বাঙালি কৃষ্টি এবং হাজার বছরের যে সংস্কৃতি আমরা লালন করে আসছি সেখানে পাশ্চাত্যের অনেক কিছুই আমরা নিয়েছি, গ্রহণ করেছি। ভালো কিছু আমাদের জন্যও ভালো আছে। আমাদের অনেক কিছু আছে যেগুলো বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। সেগুলো আমরা নিতে চাই না এবং না নেওয়াটাই ভালো। মা দিবসটা অনেক বছর ধরেই এখন আমাদের কাছে আলাদা কিছুই না। আমরা অন্যান্য দিবসের মতো মা দিবস পালন করি। তবে আমার কাছে আলাদা করে মা দিবস পালন করার কিছুই নেই। এখনো আমরা অতদূর পর্যায়ে যায়নি যে, বছরের একটা দিন আলাদা করে স্মরণ করার। মা প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত এখনো আমাদের অন্তরজুড়ে আছেন। সমস্ত সত্তাজুড়ে আছেন। হয়তো জীবন-জীবিকার নিষ্ঠুরতায় মায়ের ভালোবাসা থেকে দূরে থাকছি। তবে আমাদের সেই অপূর্ণতা মা তার হৃদয়ের বিশালতা দিয়ে ঢেকে দেন। মা তো এমনই হয়, তাই না?

 

এ বয়সেও কোনো ক্লান্তি নেই। এত এনার্জি কোথা থেকে পান?

সব তার দয়া, আল্লাহপাকের ইচ্ছা। আমার জন্মটা তো একটা দুঃসময়ে হয়েছে মনে করি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। আমার আম্মা গল্প করতেন যে, সে সময় দুধ পাওয়া যেত না। পালিয়ে গেছে লোকজন। গরুর দুধ বা অন্য খাবার তথা শিশুখাদ্য তো তখন ছিলই না। তখন খুব কষ্ট করে আমাকে ভাতের মাড় খাওয়াতেন আমার কিশোরী মা! কিশোরী বয়সে আমি তার গর্ভে এসেছি। আমার বাবার কর্মস্থল ছিল বর্ধমানে। তো যুদ্ধের জন্য সে দেশে যাবে, মায়ের আদর পাবে, সে সুযোগও ছিল না। বর্ধমান আর আমাদের দেশ হলো নোয়াখালী। তো তখনকার দিনে নৌকায় বা স্টিমারে, এরপর ট্রেনে করে যেতে হতো। মায়ের কাছে গল্প শুনেছি, তিন দিন লেগে যেত। আমাদের বর্ধমানের বাসা ছিল দোতলা। তো সিঁড়ি দিয়ে উঠে যখন ওপর-নিচে তাকাতো সে, তখন মনে হতো পুরো পৃথিবীটা ঘুরছে। তিন-চার দিন লেগে যেত উনার সুস্থ হতে। আমার কাছে মনে হয় যে, ওই রকম একটা বিধ্বস্ত এবং দুর্যোগপূর্ণ সময়ে আমার জন্ম দেখে আমিও বোধহয় কষ্টসহিষ্ণু হয়েছি, আল্লাহপাক কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েছেন। তারপরে তো এ জীবনে পাকিস্তান পিরিয়ড গেল। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন। সংগ্রামে-মিছিলে পাকিস্তানি আর্মিরা আমাদের তাড়া করত। আমরাও দৌড়াতাম তাদের কাছ থেকে আত্মরক্ষার জন্য। মুক্তিযুদ্ধ হলো। তখন আবার সেই গ্রামে গিয়ে পালিয়ে থাকা। পাকিস্তানি হানাদারদের সেই লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। তখন তো আমার বয়সকাল। তো এসব করতে করতে মনে হয় যেন শক্তি নিজে থেকেই ভিতরে চলে এসেছে। এখন একা থাকি, কষ্ট করি। তবে কষ্ট মনে হয় না। নিজে বাজার করি। নিজে রান্না করি। আমার কাজের লোক নেই। খারাপ লাগে না এ জীবনযাপন। অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

 

বলেছিলেন শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। তো সব মিলিয়ে এখন কেমন আছেন? 

মেঘে মেঘে তো অনেক বেলা হয়েছে। শরীর তো খারাপই থাকবে। আমি তেমন করে এটিকে খারাপ মনে করি না। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আঁশ। যতক্ষণ আছি কাজ করি সুস্থ থাকি বা না থাকি। মনে করি যে, হ্যাঁ সুস্থ আছি আর কি! ভালো আছি।

 

সেই দুরন্ত কৈশোর অর্থাৎ কিশোরী জীবনের কিছু স্মৃতি শেয়ার করবেন কি?

আমি খুবই দুষ্টু ছিলাম। তখন ভীষণ রোগা-পাতলা ছিলাম। আর আমার সব ছেলেবন্ধু। ওদের সঙ্গে দৌড়াতাম, এর-ওর বাগানের পেয়ারা পাড়তাম। মজার বিষয় হলো, আমাকে সবাই গাছে উঠিয়ে দিত পেয়ারা পাড়ার জন্য। কারণ, আমি যে চিকন ছোটমতো! এরপর কোঁচড় ভরে পেয়ারা পেড়ে নেমে আসতাম। আর মেঘ, ঝড়-বৃষ্টি শুরুর আগে মা যখন ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করত সেই ফাঁকে ফুট করে বাইরে দৌড়ে বের হয়ে যেতাম আম কুড়াতে। এরপর যখন ফিরে আসতাম তখন মা পাখার ডাট দিয়ে দুটো বাড়ি দিত। বলত, এ্যাই বাজ পড়লে বা গাছের ডাল ভেঙে মাথায় পড়লে কী হতো! সেই রকম দুষ্টু ছিলাম।

 

অনেক দুষ্টু ছিলেন, কিন্তু চরিত্রগুলো করেন ভীষণ মিষ্টি ও মায়াময়ী। যদিও শোবিজে যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘দজ্জাল’ চরিত্র দিয়ে...

দজ্জাল, এখন এ শব্দটা শাশুড়িদের জন্য বা দজ্জাল বউ। কিন্তু ছেলেদের জন্য তো লেখে না! আমি তো একবার একটা শোতে বলেছি যে, যত কঠিন কঠিন সব বিশেষণগুলো শরৎচন্দ্রবাবু ব্যবহার করেছেন। তাই শরৎচন্দ্রের ওপর আমার ভীষণ রাগ। তবুও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাকে। আমাদের বেলায় যত তার এ বিশেষণগুলোর ব্যবহার। উনারা খুবই অবিচার করেছেন আমাদের ওপর।

 

তাহলে কী বিশেষণ ব্যবহার করলে ভালো হতো?

কেন, আমাদের কত সুন্দর ও কোমল দিকগুলো আছে। দজ্জাল বউ কেন? মেয়েটি ঠিকই দেখা যায় যে তার বরের জন্য মাছের টুকরা ভালো করে রেখে দেয়। আর মা তো কখনোই খায় না দুধের সর, বল। আমরা তো ছোটবেলায় দুধের সর খেয়ে বড় হয়েছি। খুব ভালো জিনিসগুলো তুলে রেখে দিত আমাদের জন্য। শুধু দজ্জাল মা বা দজ্জাল শাশুড়ি বা স্ত্রী কেন, বোনদেরও ¯েœহ দেখ। অন্যরকম। আমার ছোটভাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত। ছুটির দিনে হয়তো একবার দেখা করতে আসত। আমার মনে আছে, তখন বাবা নারায়ণগঞ্জ থেকে জিপ গাড়িতে করে আম নিয়ে আসতেন। খাটের নিচে সব আম বিছিয়ে রাখতেন। কত আম যে টিপে টিপে নরম করে খেতাম। আমি যখন এ গল্প আমার মেয়েকে বলি সে বলে, ‘এসব আবার কি খাওয়া?’ আমি বলি, ‘খেয়ে দেখ কেমন মজা লাগে।’ বলি, ‘তোমরা যেমন পাইপ দিয়ে জুস খাও তেমনি আমরা এমন আম খেয়েছি।’ তো, আম শেষ হয়ে যাবে, ভাইটা আসে কি না! আমি তখন দুই-তিনটা আম লুকিয়ে নিয়ে আলমারিতে রেখে দিতাম। সবাই তো ভালো ভালোগুলো খেয়ে শেষ করে ফেলবে আর ও যেদিন আসবে সেদিন হয়তো পাকাগুলো পাবে না। তো, আম যে ওইখানে রেখেছি মনে নেই। আমগুলো পেকে আলমারিতে রাখা আম্মার শাড়ি নষ্ট হওয়ার মতো অবস্থা। আম্মা তো পারলে আমাকে পিটায় আর কি! তখন অবশ্য কলেজে পড়ি। তো সেই মায়াভরা স্মৃতিগুলো কোথায় হারিয়ে গেল! এখন দুই-তিনটা আম কিনে নিয়ে আসি। কত দাম! আর একসময় তো খাটের নিচে এত এত আম বিছিয়ে রাখা হতো। খাবার ঘরের এক কিনারার পুরো অংশ আম বিছিয়ে রাখত। ল্যাংড়া আমের এক রকম গন্ধ, একেক আমের একেক গন্ধ। এখন তো সেই গন্ধটাই নেই। এরপর সেই আম পাকত একটা একটা করে। এরপর আমের আমসত্ত্ব। সেগুলো এখন মনে হয় স্বপ্নের মতো।

 

পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন...

পালিয়ে নয় ঠিক। তখন চিঠির মাধ্যমে উনার সঙ্গে যোগাযোগ হতো। টেলিফোনে যোগাযোগ করার মতো অবস্থা ছিল না। এখনকার মতো তো মোবাইল ছিল না। তখন কামাল, আমার ভাই (মারা গেছে) ছিল পত্রবাহক। উনি আবার কেমন কেমন করে যেন ওর (কামাল) সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলেছে। তো ইতোমধ্যে আমার অনেক বিয়ের অফার এসেছে। এরমধ্যে একটা ভালো পাত্রের অফার ছিল। কিন্তু আমি তো রাজি নই। তো আমি উনাকে চিঠি পাঠালাম। লিখলাম- তোমার রাজকন্যা তো এখন বন্দি। আমি এরপর এক দিন সাহস করে বললাম যে, আমি বিয়ে করব না, আমার পছন্দ আছে। আম্মা তো বাবাকে সামনে পেয়ে বলল, বারবার বলেছি লেখাপড়া করার দরকার নেই ওর। বলেছিলাম ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর ওর বিয়ে দিয়ে দাও। এখন দেখ। এরপর আমার ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া বন্ধ। আমি তারপর চিঠি লিখলাম- তোমার রাজকন্যা দৈত্যপুরীতে বন্দি, তুমি পঙ্খীরাজে এসে রাজকন্যাকে উদ্ধার কর, না হলে রাজকন্যাকে আর পাবে না। পরে উনি আমার ভাইকে চিঠি লিখলেন। তখন আড়াই শ টাকা পায় স্কলারশিপ। আব্বা বললেন, আড়াই শ টাকা দিয়ে ও কী খাবে আর তোমাকে কী খাওয়াবে? এরপর আমি আস্তে করে সবার অলক্ষ্যে যেই কাপড় পরা সেইটা পরেই বেরিয়ে গেলাম কালামকে সঙ্গে করে। এরপর বিয়ে হলো জিয়া হায়দার, উনার বন্ধুর কাগজিটোলার বাসায়। তখন সর্দার জয়েনউদ্দিনও ছিলেন। কামালসহ সবাই ছিল সাক্ষী হিসেবে। সবাই বলতে লাগল, একটি ঐতিহাসিক বিয়ে হলো দুই সাহিত্যিকের। এরপর মামা বিয়ের কথা মা-বাবাকে জানালেন। তো আমাদের বিয়েকে মেনে নিতেই হলো।

 

শুনেছি একটা ডিম দুজনে ভাগ করে খেতেন...

কষ্টের দিন। একসঙ্গে থাকি। বাসা ভাড়া দিই ২০০ টাকা। ৫০ টাকা থাকে হাতে। এরপর আমি উনার রিসার্চ কাগজগুলো এক পাতা করে লিখি। এক পাতা লিখলে আট আনা পাই। কপি করে দিই। দশ পাতা লিখলে যে টাকাটা পাই, রেডিওতে একটা গল্প পড়লে ১৫ টাকা, এভাবে জীবন শুরু। দুটো পরাটা চার  আনা চার আনা করে আর একটা ডিমভাজা আট আনা-এই ১ টাকা দিয়ে কিনে দুজনে ভাগ করে খেয়েছি আর কি!

সর্বশেষ খবর