শিরোনাম
শনিবার, ১ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

যেভাবে কফি হাউসের সেই আড্ডাটা...

শোবিজ ডেস্ক

যেভাবে কফি হাউসের সেই আড্ডাটা...

সেই ঐতিহাসিক কফি হাউস

‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই

কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই

আজ আর নেই...।’

১৯৮৩ সালে মুক্তি পায় এই কালজয়ী গানটি। মুক্তির পর থেকে আজও গানটি শুধু শ্রোতাপ্রিয় নয়, এককথায় অমর হয়ে আছে। ২০০৬ সালে বিবিসি জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় এ গানটি চতুর্থ অবস্থান দখল করে নিয়েছে।

গানটি এতই জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে, শ্রোতারা এর স্মৃতি খুঁজে পেতে চলে আসেন কলকাতার সেই কফি হাউসে, যেখানে গানের পটভূমি অনুযায়ী মান্না দে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

তবে মান্না দে এ গানটির দ্বিতীয় অংশ হিসেবে ‘স্বপ্নের কফি হাউস’ শীর্ষক একটি গান প্রথম গানটির ঠিক কুড়ি বছর পর গেয়েছিলেন। কিন্তু রহস্যময় কারণে সেটি শোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বাঙালি।

গুগলে কফি হাউসের সেই আড্ডাটা গানটির ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের কথায় সুর দিয়েছিলেন নচিকেতার ছেলে সুপর্ণকান্তি ঘোষ। মান্না দের মতে, গৌরীবাবু লিখেছিলেন দুর্দান্ত। সুরকার সুপর্ণকান্তি অসাধারণ কাজ করেছিলেন।

এ গানটির জন্মকাহিনি বেশ গল্পের মতো। সময়টা ১৯৮৩ সাল। গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার তখন আশা ভোঁসলেকে নিয়ে প্রচুর হিট প্রেমের গান লিখে চলেছেন। কিন্তু পূজার গান মান্না দের জন্য তিনি লিখতে পারছেন না। সবই লিখছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল গৌরী প্রসন্নের মনে। এ সময় এক দিন নচিকেতা ঘোষের নিউ আলিপুরের বাড়িতে গিয়েছিলেন গৌরী প্রসন্ন। উদ্দেশ্য ছিল শক্তি ঠাকুরকে দিয়ে একটি গান তোলা। সেই সময় সেরা জুটি ছিলেন নচিকেতা ও গৌরী প্রসন্ন। সেই সূত্রে নচিকেতার ছেলে সুপর্ণকান্তির সঙ্গেও বেশ ভালো সম্পর্ক। তবে বাড়িতে আসার অনেকক্ষণ পর সুপর্ণকান্তিকে দেখতে পেয়ে গৌরী প্রসন্ন মজা করেই বলেন, এ কী বাইরে আড্ডা মেরে সময় কাটাচ্ছো? এর উত্তরে সুপর্ণকান্তি তার গৌরী কাকাকে বলেন, সব গদগদে প্রেমের গান লিখছো। একটা অন্যরকম গান লিখে দেখাও না। এ আড্ডা নিয়েও তো গান লিখতে পার। এবার গৌরী প্রসন্ন বলেন, তুমি তো অক্সফোর্ডের এমএ হয়ে গিয়েছো। আড্ডা নিয়ে বাংলা গান গাইবে? সুপর্ণ এবার বলে, কেন নয়। কফি হাউসের আড্ডা নিয়েও তো একটা গান লিখতে পার। গৌরী প্রসন্ন এবার বলেন, তোমার বাবা (নচিকেতা ঘোষ) কি আর সে গান গাইবেন? তর্ক চলছে বটে কিন্তু গৌরী প্রসন্ন এরই মধ্যে মনে মনে তৈরি করে ফেলেন দুটি লাইন।

‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই

কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই

আজ আর নেই...’

এর পরেই সুপর্ণকান্তিকে বললেন, লিখে নাও- ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই।’ সুপর্ণও সঙ্গে সঙ্গে দুটো লাইনেই সুর দিয়ে শুনিয়ে দেন। উপস্থিত শক্তি ঠাকুর সেবার পূজায় গানটা গাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও সুপর্ণ রাজি হননি। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে নিয়েছিলেন মান্না দের কথা।

সেই কফি হাউসে কণ্ঠশিল্পী মান্না দে

কিন্তু গানের বাকি লাইনগুলো? পরের দিন সকালেই গৌরী প্রসন্নের স্ত্রী সুপর্ণকান্তিকে ফোন দিলেন। সারা রাত জেগে বহুদিন পর গান লিখেছেন অসুস্থ গৌরী প্রসন্ন। তখনই তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। দুই দিন পর গানটা নিয়ে হাজির। কিন্তু শেষ স্তবক যোগ করার পক্ষপাতী ছিলেন না গৌরী প্রসন্ন। সুপর্ণকান্তি চান যোগ করুন একটি স্তবক। শেষ পর্যন্ত রাজি হন। লিখেন দুর্দান্ত সেই লাইন- ‘সেই সাতজন নেই, তবুও টেবিলটা আজও আছে।’ কিন্তু শেষ তিনটি লাইন তিনি লিখেছিলেন চেন্নাইয়ে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার পথে হাওড়া স্টেশনে বসে একটি সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে। এক চেনা লোকের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দেন সুপর্ণকান্তির কাছে। তারপর সুপর্ণকান্তির সুরে মুম্বইয়ে গানটি রেকর্ড করেন মান্না দে। তৈরি হয়ে যায় একটা ইতিহাস। তবে কফি হাউসের দ্বিতীয় অংশ হিসেবে পরবর্তী সময়ে ‘স্বপ্নের কফি হাউস’ নামে একটি গান রেকর্ড করেছিলেন মান্না দে। একটি নতুন রেকর্ড কোম্পানিই রেকর্ড করিয়েছিল গানটি। কিন্তু সুপর্ণকান্তি জানিয়েছেন, সেই গানের অরিজিনাল স্পুলটি পাওয়া যায়নি। ফলে অন্য স্পুল দিয়ে কাজ করতে হয়েছিল। নিখিলেশ, মঈদুলদের নিয়ে দ্বিতীয় গানটি লিখেছিলেন শমীন্দ্র রায় চৌধুরী। প্রথম গানের স্কেলেই গানটা করেছিলেন মান্না দে। দ্বিতীয় গানটি প্রথমটির থেকেও সুরের বৈচিত্র্যের বিচারে অনেক ভালো হয়েছিল। কিন্তু কোথায় গেল সেই স্বপ্নের কফি হাউস কেউ জানে না। মান্না দেও হতাশ ছিলেন এ নিয়ে। তিনি শুধু বলেছেন, ‘বাঙালি তো জানতেই পারল না সেই গানের কথা।’

কফি হাউস নিয়ে মান্না দের অপ্রকাশিত দ্বিতীয় গানের কথা ছিল এমন-

 

কফি হাউস-২

স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো কফি হাউসেই,

আজ আর নেই

জীবনে চলার পথে হারিয়ে গিয়েছে অনেকেই,

আজ আর নেই

নিখিলেশ লিখেছে প্যারিসের বদলে

এখানেই পুজোটা কাটাবে

কী এক জরুরি কাজে ঢাকার অফিস থেকে

মঈদুলকেও নাকি পাঠাবে

একটা ফোনেই জানি রাজি হবে সুজাতা

আসবে না অমল আর রমা রায়

আমাদের ফাঁকি দিয়ে কবেই তো চলে গেছে

ওদের কখনো কি ভোলা যায়?

স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো কফি হাউসেই,

আজ আর নেই

জীবনে চলার পথে হারিয়ে গিয়েছে অনেকেই,

আজ আর নেই

ওরা যেন ভালো থাকে একটু দেখিস তোরা

শেষ অনুরোধ ছিল ডিসুজার

তেরো তলা বাড়িতে সবকিছু আছে তবু

কীসের অভাব যেন সুজাতার

একটাও তার লেখা হয়নি কোথাও ছাপা

অভিমান ছিল খুব অমলের

ভালো লাগে দেখে তাই সেই সব কবিতাই

মুখে মুখে ফেরে আজ সকলের

স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো কফি হাউসেই,

আজ আর নেই

জীবনে চলার পথে হারিয়ে গিয়েছে অনেকেই,

আজ আর নেই...।

সর্বশেষ খবর