সোমবার, ৩ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

কেমন চলছে ঢাকাই চলচ্চিত্র জগৎ

কেমন চলছে ঢাকাই চলচ্চিত্র জগৎ

কমপক্ষে নব্বই দশকের শেষভাগ থেকে নানা অবক্ষয়ের কারণে ঢাকাই চলচ্চিত্র জগৎ প্রচণ্ড খরা ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোচ্ছে।  মাঝেমধ্যে মরণ খরার মাঝে কিছুটা আশার আলো দেখা গেলেও পরক্ষণে তা আবার মিলিয়ে যায়। বর্তমানে আমাদের চলচ্চিত্র জগতের অবস্থা কেমন? চলচ্চিত্রকারদের সেই কথা তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

এই জগৎ এখন চাকাবিহীন গাড়ি

সোহেল রানা [চলচ্চিত্রকার]

যার অস্তিত্বই নেই এখন সেটি নিয়ে কীভাবে কথা বলব। চলচ্চিত্র জগৎ এখন আমার কাছে চাকাবিহীন গাড়ির মতো। যেটা আর চলছে না। দু-একজন এ জগৎকে ভালোবেসে এর উন্নয়নের চেষ্টা করছে বটে, এমন সব চলচ্চিত্রপাগল খেপাটের কারণে চলচ্চিত্র জগৎ এখনো যৎসামান্য টিকে আছে। শিল্পী সংকটও তুঙ্গে, এ সংকট কাটানোর মতো পর্যাপ্ত ছবি কি তৈরি হচ্ছে? তবে আমার মতে শিল্পী, সিনেমা হল, দর্শক, নির্মাতা, কোনোটিরই আসলে কোনো সংকট নেই। পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবিরই সংকট রয়েছে। নতুনরা কাজ করতে আসছে, কিন্তু তারা আমাদের মতো চলচ্চিত্রকে ভালোবেসে আসছে বলে মনে হয় না। তারা আসছে সহজে অর্থ বিত্ত আর খ্যাতি পেতে, যা অসম্ভব। অনেকে নিজেকে ভাঙতে পারছে না। এক বৃত্তেই নিজের ইমেজকে বন্দি রেখেছে। এখন যারা আসছে তাদের শুরুতেই টার্গেট থাকে সহজেই অর্থ, খ্যাতি, বউ, গাড়ি, বাড়ি পাওয়া। এতে সুফল আসবে কোথা থেকে। আগে শিল্পীর কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিল। যেমন একবার আমি সাবিনা ইয়াসমিনের বাসায় গেলাম একটা কাজে। কিন্তু ওর মা এসে বললেন, আপনি বসেন ও রেওয়াজ করছে। অনেকটা সময় বসে থাকার পর সাবিনা বের হয়ে এসে বলল, সরি আমি গানের রেওয়াজ করছিলাম। প্রতিদিন এ সময় রুটিন করে তাই করি। সে কারণে সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসতে পারলাম না। তার কাজের প্রতি এ ভালোবাসাকে আমি এপ্রিসিয়েট করেছি। এখন এ অবস্থা নেই বলেই চলচ্চিত্র জগৎসহ সব সেক্টরের এমন নাজুক অবস্থা চলছে। আরেকটি বিষয় হলো চলচ্চিত্রের মানুষদের এদেশে সরকারসহ কেউ-ই যথাযথ মূল্যায়ন করে না। ফলে হতাশা থেকে সবাই কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আমি সরকারকে বলব, যেখানে আমাদের মূল্যায়ন নেই সেখানে সম্মাননা দিয়ে কী হবে। আমরা যারা চলচ্চিত্রে আজীবন জাতীয় সম্মান পেয়েছি তাদের এখনো কমপক্ষে এয়ারপোর্টে গেলেও ভিআইপি মর্যাদা দেওয়া হয় না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আমি বলব বড় মাপের সম্মাননা তো আর দ্বিতীয়বার দেওয়া হয় না, যে পুরস্কার দ্বিতীয়বার দেওয়া যায় না তাকে কি ভিআইপি মর্যাদাও দেওয়া যায় না। সব শেষে সরকারকে বলব, প্রাইস নয় আমাদের ভেল্যু দিন, তবেই চলচ্চিত্র জগতের উন্নতি হবে।

 

আশার আলো দেখতে পাচ্ছি

ছটকু আহমেদ [চলচ্চিত্রকার ও সিনিয়র সহসভাপতি পরিচালক সমিতি]

ঢাকাই চলচ্চিত্র জগতে নতুন করে আশার আলো জ্বলে উঠছে। এখন নতুন এবং তরুণ নির্মাতারা সময়োপযোগী ছবি নির্মাণ করছে এবং দর্শক তা সাদরে গ্রহণ করছে। এর পরিমাণ যদিও এখন কম তারপরেও অনেক বড় মাপের বিনিয়োগকারীরা এখন চলচ্চিত্র নির্মাণ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এটা চলচ্চিত্রের জন্য একটা শুভ লক্ষণ। এ ছাড়া বর্তমান সময়ে ছবি প্রদর্শনের নতুন মাধ্যম ওয়েব প্ল্যাটফরমগুলোও নির্মাণ ও প্রদর্শনে এগিয়ে আসছে। এমন আশার আলোকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের যে সীমাবদ্ধতাগুলো রয়েছে, যেমন- শিল্পী, প্রযুক্তি, সিনেমা হল, সময়োপযোগী গল্প, প্রশিক্ষণসহ সব অভাব চলচ্চিত্রকারদের সম্মিলিত প্রয়াসে দূর করতে হবে। দলাদলি, অপরিপক্বতা, অশিক্ষা, অনভিজ্ঞতা, অবক্ষয় থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এখন কিছু ওয়েব ফিল্ম বা সিনেমা নির্মাণ হয় যাতে গালাগাল ও কুরুচিপূর্ণ দৃশ্যে পরিপূর্ণ থাকে। একশ্রেণির দর্শক আবার তা দেখে। এটি অসম প্রতিযোগিতার পর্যায়ে চলে গেছে। এ ব্যাপারে চলচ্চিত্রের মানুষকেই সচেতন হতে হবে। আরেকটি দুঃখজনক বিষয় হলো- চলচ্চিত্রের মানুষ কে কাকে টেনে নিচে নামাবে সেই অপচেষ্টায় সব সময়ই মগ্ন থাকে। দেশীয় চলচ্চিত্রের উন্নতির স্বার্থে এই মন মানসিকতা পরিহার করতে হবে। আর সমিতি খারাপ কিছু নয়, এটি চলচ্চিত্রের মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে। সমিতির বদনাম বয়ে আনছে কিছু অজ্ঞ বিকৃত রুচির মানুষ। এদের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। সরকার সিনেমা হলের উন্নয়নে ঋণ দিতে চাচ্ছে, কিন্তু সিনেমা হল মালিকরা পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাবে সেই ঋণ নিতে পারছেন না। কারণ মানসম্মত ছবি না পেলে আয় হবে কীভাবে এবং ঋণের টাকা ফেরত দেবে কোথা থেকে। এমন সব নেতিবাচক অবস্থা থেকে চলচ্চিত্রের মানুষদেরই বেরিয়ে আসতে হবে। তবেই এ জগতের উন্নয়ন হবে।

 

জানি না কী হবে

ববিতা [চলচ্চিত্রকার]

চলচ্চিত্র জগৎ নিয়ে কথা বলার মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছি বহু আগে। কারণ দেশের এ প্রধান গণমাধ্যমটি নানা অবক্ষয়ে জড়িয়ে পড়বে এমনটি কখনো শুভ লক্ষণ নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো চলচ্চিত্রের মানুষের মধ্যে দিন দিন অনৈক্য বাড়ছে। এ কারণেই এখন এখানে আর সৃষ্টিশীল ও কালজয়ী কিছু তৈরি হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে চলচ্চিত্র জগতের ভবিষ্যৎ কী হবে জানি না। অথচ একসময় এ অবস্থা ছিল না বলেই আমাদের দেশের চলচ্চিত্র বিদেশের মাটিতেও সম্মান কুড়িয়েছে। চলচ্চিত্র জগতের মন্দাবস্থার কারণে বহু আগেই আমি এ জগৎ থেকে সরে এসেছি। এখন কিছু নতুন নির্মাতা মাঝেমধ্যে ভালো ছবি উপহার দিচ্ছে। এ উদ্যোগ বাড়াতে পারলে হয়তো আমাদের চলচ্চিত্রের প্রতি দর্শকের আস্থা আবার ফিরে আসবে।

 

এই জগৎ ভালো নেই

কাজী হায়াৎ [চলচ্চিত্রকার ও সভাপতি পরিচালক সমিতি]

চলচ্চিত্র জগৎ ভালো নেই, শেষ পর্যন্ত ভারতীয় ছবি এনে সিনেমা হল বাঁচানোর চেষ্টাও বুঝি কাজে লাগছে না। কারণ এ সপ্তাহে একটি ভারতীয় ছবি এখানে মুক্তি দেওয়া হলেও দর্শক তা দেখছে না। আমাদের এখানে প্রকৃত শিল্পীরও অভাব রয়েছে। একজন তারকা দিয়েতো বছরে ১০/২০টি ছবি নির্মাণ অসম্ভব। এফডিসির নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রমও বহু আগে অজ্ঞাত কারণে স্থগিত হয়ে আছে। আমি চলচ্চিত্রকার ও সমিতির নেতাদের অনুরোধ করব আপনারা সম্মিলিত উদ্যোগে নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রম চালু করুন। এতে নতুন শিল্পী বেরিয়ে আসুক এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দর্শক গ্রহণযোগ্য শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলি। আরেকটি কথা হলো চলচ্চিত্রের এ দুর্দিনে হাতে ছবি না থাকাতে চলচ্চিত্রের মানুষরা সমিতিমুখী হয়ে পড়েছে। তারা এখানে এসে আড্ডা, পিকনিকসহ নানাভাবে অর্থ আয়ের চেষ্টা করছে, এগুলো ঠিক নয়। সমিতির নেতাদের সম্মিলিতভাবে চলচ্চিত্রের উন্নয়নের চেষ্টা করতে হবে। সরকার সিনেমা হলের উন্নয়নে ঋণ দিচ্ছে, কিন্তু সেই ঋণ সবাই নিতে ভয় পাচ্ছে, কারণ ছবি না পেলে সেই ঋণ শোধ করা যাবে না এবং তাদের জায়গা নিলামে ওঠবে। শুনেছি কিছু কিছু সিনেমা হল মালিক ঋণ নিয়ে সুবিধা করতে পারছেন না ছবির অভাবে। এদিকে জোনাকি সিনেমা হলের নিচতলা ভাড়া দিয়ে ১০ লাখ টাকা পেয়েছে এর মালিক। কিন্তু সারা বছর ছবি চালিয়েও দর্শকের অভাবে এ ১০ লাখ টাকা পাওয়া যেত না। তাই বাধ্য হয়ে সিনেমা হল মালিকরা অন্য পথে ঝুঁকছে। চলচ্চিত্রের এমন সব নেতিবাচক অবস্থার উন্নয়ন চলচ্চিত্রের মানুষকেই একতাবদ্ধ হয়ে দূর করতে হবে।

 

পর্যাপ্ত মানসম্মত ছবি নেই

মিয়া আলাউদ্দীন [কর্মকর্তা, প্রদর্শক সমিতি]

আমরা সিনেমা হল মালিকরা অনরবরতই বলে আসছি সিনেমা হল বাঁচাতে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি চাই। যেটি বহু বছর ধরে পাচ্ছি না। তাই সিনেমা হল বাঁচাতে বাধ্য হয়ে বিদেশি ছবি আনার উদ্যোগ নিতে হয়েছে। সেখানেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে কোনো সুফল পাচ্ছি না। এখন মাঝেমধ্যে কিছু ভালো ছবি এলেও পরিমাণে তা খুবই কম। তাই বলব, শুধু সিনেমা হল নয়, আমাদের চলচ্চিত্র জগৎকে বাঁচাতে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির বিকল্প নেই।

 

ভালো অবস্থা ফিরছে

খোরশেদ আলম খসরু [চলচ্চিত্র প্রযোজক]

চলচ্চিত্র জগতের অবস্থা আবার ভালোর দিকে এগোচ্ছে। এখন নতুন ও তরুণ নির্মাতারা ভালো ছবি নির্মাণ করছেন এবং দর্শক তা সিনেমা হলে গিয়ে দেখছে। যেমন- গলুই, দিন দ্য ডে, প্রিয়তমা, হাওয়া, পরাণ, রাজকুমার। এসব ছবি ভালো সাড়া জাগিয়েছে। এখন আসছে তুফান, দরদসহ আরও অনেক ভালো ছবি। আগে যেখানে দর্শক সিনেমা হলে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিল সেখানে এখন তারা  ভালো ছবি পেয়ে আবার সিনেমা হলমুখী হচ্ছে। এটি চলচ্চিত্র জগতের জন্য অবশ্যই শুভ লক্ষণ। এভাবে ভালো ছবি নির্মাণ হলে অচিরেই আমাদের চলচ্চিত্র জগৎ আবার ঘুরে দাঁড়াবে। তাই চাই মানসম্মত, পর্যাপ্ত ও সময়োপযোগী গল্পের ছবি। এদিকে সিনেমা হল উন্নয়নে সরকার যে ঋণের ব্যবস্থা করেছে তা একদিকে ব্যাংকের দীর্ঘসূত্রতা ও অন্যদিকে সিনেমা হল মালিকরা পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি না পাওয়ার কারণে সুফল বয়ে আনছে না।

অন্যদিকে চলচ্চিত্র  সমিতির কারণে নয়, বিশেষ ব্যক্তির কারণে সমিতির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে বলে আমি মনে করি। আরেকটি বিষয় হলো-  এখানে প্রকৃত শিল্পী প্রকট। এ সংকটের সমাধান হলো নতুন মুখের সন্ধান করা। যারা অভিনয়ে আছে তারা অভিনয়ের চেয়ে নিজেদের প্রচার, সহজে অর্থবিত্ত ও খ্যাতির পেছনে ছুটতে গিয়ে অকালেই হারিয়ে যাচ্ছে। এসব নেতিবাচক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে আমাদের চলচ্চিত্র জগতের সামগ্রিক উন্নয়ন অবশ্যই হবে।

সর্বশেষ খবর