বুধবার, ২৬ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্রের পালে সুবাতাস

আলাউদ্দীন মাজিদ

চলচ্চিত্রের পালে সুবাতাস

ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘তুফান’ ছবিতে মিমি চক্রবর্তী

চলচ্চিত্রের পালে আবার সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। এ ঈদে মুক্তি পাওয়া রায়হান রাফি পরিচালিত তুফান ছবিটি এ স্বস্তির হাওয়াকে যেন আরও ত্বরান্বিত করেছে। ছবিটি দেখতে দর্শক সিনেমা হলগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। টিকিট না পেয়ে হলে ভাঙচুরের খবরও পাওয়া গেছে। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকার মধুমিতা সিনেমা হলে ভাঙচুর চালিয়েছেন বিক্ষুব্ধ দর্শক। টিকিটের জন্য সিনেমা হলে এমন উন্মাদনা দেখা যেত আশির দশক পর্যন্ত। এখানেই তুফান উন্মাদনার শেষ নয়, স্টার সিনেপ্লেক্সের দুই দশকের ইতিহাসে বাংলা চলচ্চিত্রের মধ্যে সর্বোচ্চ শোর রেকর্ড গড়েছে তুফান। স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, ঈদের দ্বিতীয় দিন স্টার সিনেপ্লেক্সের সব আউটলেট মিলিয়ে ছবিটির ৪৭টি শো চালানো হয়েছে। এর আগে বাংলা কোনো সিনেমার এত শো চালানো হয়নি। পরের সপ্তাহে এ শোয়ের পরিমাণ ৫৩তে উন্নীত হয়েছে। শোর হিসাবে প্রিয়তমা, পরাণ ও হাওয়া সিনেমাকে ছাড়িয়ে গেছে তুফান। ঈদের দিন স্টার সিনেপ্লেক্সে ২২টি শো দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল তুফান, দর্শকের চাপে শো বাড়তে বাড়তে ৫১টিতে পৌঁছেছে। শো আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান মেজবাহ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ছবিটি দেখতে দর্শকের প্রচুর চাপ ছিল। ব্যাড বয়েজ-এর মতো সিনেমার শো কমিয়ে তুফানের শো বাড়ানো হয়েছে। শো বেড়েই চলেছে, কমার কোনো লক্ষণ নেই।’ ঢাকার আরেক সিনেপ্লেক্স লায়ন সিনেমাসে ঈদের দিন পাঁচটি শো চালানো হয়েছে। দর্শকের চাপে এখন প্রতিদিন ১০টি শো চালানো হচ্ছে। প্রেক্ষাগৃহটির কর্ণধার মির্জা আবদুল খালেক জানান, তুফান সিনেমার প্রায় সব শো হাউসফুল যাচ্ছে। দেশের অন্যান্য স্থানেও একই অবস্থা বলে জানা গেছে। এর আগে গত ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া রাজকুমার এবং মোনা জীন টু ও আদর আজাদ-পূজার ‘লিপিস্টিক’ দর্শক নজর কেড়েছে।

ঢাকাই চলচ্চিত্রের পালে এ সুবাতাস নতুন করে বইতে শুরু করেছে কমপক্ষে ২০২২ সাল থেকে। এর আগে নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা, নকল ও পাইরেসি ঢাকাই চলচ্চিত্রকে রীতিমতো পথে বসিয়ে দেয়। মাঝে মধ্যে দু-একটি ভালো ছবি মুক্তি পেলেও তা পরিমাণে কম থাকায় এবং দর্শকের অভাবে লোকসান গুনে ১৪৭০টি সিনেমা হলের সংখ্যা কমে এখন অর্ধশতের ঘরে নেমে এসেছে। ২০২০ ও ২০২১ সালে দেখা দেয় নতুন আরেক সমস্যা বৈশ্বিক করোনা মহামারি। এতে শুধু ঢাকাই নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্র পড়ে চরম মন্দার কবলে। যাই হোক, ২০২২ সালের ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ‘শান’ ও ‘গলুই’ দিয়ে দেশীয় সিনেমা ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজে পায়। এরপর ওই বছরের ঈদুল আজহায় ঢাকাই সিনেমা নিয়ে রীতিমতো উন্মাদনা তৈরি হয়। ঈদের ছবি পরান, হাওয়া দেখতে বন্ধুবান্ধব ও পরিবার নিয়ে সিনেমা হলে ভিড় করতে থাকে দর্শক। মুক্তির পর হাওয়া তৈরি করে বাংলা সিনেমার নতুন রেকর্ড। মুক্তির আগেই সিনেমাটির অগ্রিম টিকিট নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়, কয়েকটি মাল্টিপ্লেক্সে প্রথম দিনের টিকিট বিক্রি হয়ে যায়, দর্শকের ব্যাপক আগ্রহের কারণে বহুল আলোচিত একটি হলিউডি ছবির প্রদর্শনী স্থগিত করা হয়। ‘হাওয়া’ ছবিটি দেশের দর্শকের হৃদয় জয়ের পর উত্তর আমেরিকায় মুক্তি পায় এবং সেখানেও সাড়া জাগায়। কলকাতায় মুক্তি পেয়েও দর্শকনন্দিত হয়। তবে ২০২২ সালের শুরুতে দেবাশীষ বিশ্বাস পরিচালিত ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ টু’ ছবিটি দিয়ে এ সফলতার যাত্রা শুরু হয়। চলচ্চিত্রকার ও দর্শকদের একটিই কথা- ‘ভালো গল্প আর মানসম্মত ছবি পেলে সবাই তা সাদরে গ্রহণ করে।’ ২০২৩ সালে আবারও এ কথার প্রমাণ মিলে। ওই বছরের ঈদে মুক্তি পাওয়া প্রিয়তমা, সুড়ঙ্গ, প্রহেলিকা ছবির প্রতি দর্শক আগ্রহ তাই বলেছে। পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রনির্মাতা ছটকু আহমেদ বলেন, সময়ের পথে হেঁটে নতুনত্বের কাঁধে ভর করে এ সুদিনের হাওয়া লেগেছে। উদ্ভট ও অবাস্তব গল্পের পরিবর্তে জীবনের গল্প নিয়ে যেসব ছবি নির্মাণ হচ্ছে সেগুলো নির্দ্বিধায় দর্শকগ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। আসলে আমাদের দেশে মৌলিক ও জীবনধর্মী গল্পের অভাব নেই। দর্শক চলচ্চিত্রে নিজের পারিপার্শ্বিকতাকে দেখতে চায়। আয়নায় আপন চেহারা দেখার মতো যখন ছবিতে নিজেদের চিরচেনা জীবনচিত্র খুঁজে পায় তখনই তারা সেই ছবি দেখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। আর তখনই ছবিটি সফল হয়, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হয়। এসব ছবিতে থাকে নিজ দেশের কৃষ্টি ও কালচারের জয়গান। কিছুদিন আগে কয়েকটি বিদেশি পত্রিকা বাংলাদেশের তরুণ চলচ্চিত্রনির্মাতা ও তাদের নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রশংসা করে প্রতিবেদন ছেপেছিল। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- ‘বলিউড বা হলিউড কিংবা অন্য যে কোনো দেশের চলচ্চিত্রকে অনুকরণ না করে বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতারা গল্প বলার ক্ষেত্রে নিজস্ব ভঙ্গি তৈরি করেছেন। পত্রিকাগুলোর মধ্যে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল ডেইলি স্ক্রিন’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর শিরোনাম ছিল ‘বাংলা চলচ্চিত্রের পালে নতুন হাওয়া লেগেছে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়- বাংলাদেশের নির্মাতারা এখন ভিন্ন আঙ্গিকে গল্প বলছে। এটা ওই দেশের সিনেমার জন্য শুভ লক্ষণ। দীর্ঘদিন পর ভালো গল্পের ছবি পেয়ে সিনেমা হলে ভিড় জমিয়েছে দর্শক। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াতের কথায়- চলচ্চিত্র মানে জীবনের ছায়া। চলচ্চিত্রে ফুটে উঠবে যাপিত জীবনের ছবি। যা দেখে দর্শক তার আশপাশের চিত্র খুঁজে পেয়ে মুগ্ধ, আবেগপ্রবণ বা আনন্দিত হবেন। এ জন্য সমসাময়িক জীবনের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে।

সর্বশেষ খবর