শিরোনাম
শনিবার, ২৯ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

যেভাবে ইন্দিরা ঠাকরুনকে পেলেন সত্যজিৎ

আলাউদ্দীন মাজিদ

যেভাবে ইন্দিরা ঠাকরুনকে পেলেন সত্যজিৎ

‘পথের পাঁচালি’, প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম সিনেমা। পথের পাঁচালি উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট ছবিটি ভারতে মুক্তি পায়। এ সিনেমাটি নির্মাণে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল নির্মাতাকে। অর্থ ও শিল্পী জোগাড়সহ নানা প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত সরকারি অর্থায়নে সিনেমাটি নির্মাণ করেন তিনি। এ ছবির একজন অশীতিপর বৃদ্ধা ‘ইন্দিরা ঠাকরুন’র চরিত্রে অভিনয় করেন চুনিবালা দেবী। এটি তার অভিনীত প্রথম ও একমাত্র সিনেমা। আর এ সিনেমাতে অভিনয় করেই তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়ে যান। কিন্তু চুনিবালা দেবীকে আবিষ্কার করতে সত্যজিৎ রায়কে কম ঘাম ঝরাতে হয়নি। সত্যজিৎ ‘ইন্দিরা ঠাকরুন চরিত্রের অভিনেত্রীকে খুঁজে পাচ্ছেন না। মাথায় হাত। ওই রকম একজন বৃদ্ধা অভিনেত্রী না পেলে যে এ সিনেমা করাই যাবে না। অবশেষে সন্ধান মিলল ঠাকরুনের। পাইকপাড়ায় থাকেন এক বৃদ্ধা। বয়স আশি। নাম তার চুনিবালা দেবী। এক সকালে সত্যজিৎ হাজির হলেন চুনিবালা দেবীর বস্তির বাড়িতে। সত্যজিৎ একটা মোড়ায় মুখোমুখি বসলেন চুনিবালার সামনে। সত্যজিৎ রায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- তখন চুনিবালা দেবীর বয়স আশি পেরিয়ে গেছে। তোবড়ানো গাল, দেহের চামড়া ঝুলে পড়েছে। ঠিক যেমনটি ভেবেছিলাম এ চরিত্রটিকে ঠিক তেমনি। কথায় কথায় তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি পথের পাঁচালি পড়েছেন? বৃদ্ধা চুনিবালা অল্প লেখাপড়া শিখেছিলেন। কিছু বইও পড়েছিলেন। চুনিবালা বললেন, হ্যাঁ পড়েছি বাবা। সিনেমায় ইন্দিরা ঠাকরুন করতে পারবেন? চুনিবালা ফোকলা দাঁত বার করে হেসে বললেন, ‘তা তোমরা একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে পারব বই কি বাবা।’ আমি (সত্যজিৎ) বললাম, ‘বলুন তো একটা ছড়া? শুনি একটু।’ চুনিবালা ‘ঘুম পাড়ানির মাসিপিসি... ’ পুরো ছড়াটা গড়গড় করে সুন্দরভাবে বলে দিলেন। সত্যজিৎ রায় তার মুখে ছড়াটি শুনে বলেছিলেন, ‘ওই ছড়াটা আমি চার লাইনের বেশি বলতে পারতাম না। কিন্তু উনি সবটা বলে দিলেন। এই বয়সে আশ্চর্য স্মৃতি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বুঝে গেলাম ইন্দিরা ঠাকরুন পেয়ে গেছি। কিন্তু কলকাতা থেকে বড়াল গ্রামে প্রতিদিন শুটিংয়ে যাওয়ার ধকল এ বয়সে নিতে পারবেন কি না জিজ্ঞাসা করাতে চুনিবালা বললেন, ‘খুব পারব। তোমরা এত কষ্ট করে বই করছো, ওটুকু কষ্ট আমি ঠিক করতে পারব।’ ওনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল প্রতিদিন কত টাকা পারিশ্রমিক নেবেন। উনি বলেছিলেন ‘দিনে দশ টাকা দিও।’ সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘আপনাকে প্রতিদিন কুড়ি টাকা করে দেওয়া হবে।’ শুটিং এগিয়ে চলল। প্রতিদিন সকাল বেলায় ট্যাক্সি করে চুনিবালাকে শুটিং স্পটে নিয়ে যাওয়া হতো। সন্ধ্যা বেলায় আবার ট্যাক্সি করে ফিরিয়ে দেওয়া হতো বাড়িতে। সত্যজিৎ এক দিন চুনিবালাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি ধর্মমূলক গান গাইতে পারবেন?’ চুনিবালা বললেন, ‘পারব।’ পথের পাঁচালিতে চুনিবালা চাঁদনি রাতে দাওয়ায় বসে হাততালি দিয়ে গাইছেন সেই গান- ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো, পার করো আমারে’। চুনিবালা এ গানটা সত্যজিৎ রায়কে শুনিয়েছিলেন। সেই খালি গলায় গান শুনে সত্যজিৎ মুগ্ধ। সেই গানই রেকর্ড করা হলো। ছবিতে খালি গলায় সেই গানই গাইলেন চুনিবালা। এক অসম্ভব সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে সেই গান পথের পাঁচালি ছবিকে এক অন্য জগতে পৌঁছে দিলেন চুনিবালা। ১৯৫৫ সেই বছরে নিউইয়র্কেও সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল। সত্যজিৎ বুঝেছিলেন এ ছবির মুক্তি চুনিবালা দেবী দেখে যেতে পারবেন না। তাই প্রজেকটার মেশিন নিয়ে সত্যজিৎ এ সিনেমা চুনিবালাকে তার বাড়িতে দেখিয়ে এসেছিলেন। ছবির মুক্তি চুনিবালা দেখে যেতে পারেননি। তার আগেই ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে...’ গাইতে গাইতে চলে গেলেন তিনি। ম্যানিলা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত হলেন। চুনিবালা দেবী হলেন ভারতীয় অভিনেতা ও অভিনেত্রীর মধ্যে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত অভিনেত্রী। এক বিরল সম্মানের অধিকারিণী।

সর্বশেষ খবর