শনিবার, ৬ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা
নতুন নায়কের অভাব কেন?

ঢাকাই চলচ্চিত্রে শাকিবই ভরসা

আলাউদ্দীন মাজিদ

ঢাকাই চলচ্চিত্রে শাকিবই ভরসা

‘শ খানেক থার্ড পার্টি ব্রোকার লাগিয়ে বছর ধরে লাইন দিয়ে বসে থাকেন ১৩০টি হলের মালিক। কবে শাকিব খান তাদের একটা ছবি দেবেন আর তারা সেই প্রসাদ নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে নমঃ নমঃ করে সারা বছর তাদের পরিবারের অন্ন জোগান দেবেন। সারা বছর সিনেমা হল বন্ধ রেখে, কেউ কেউ আবার গোডাউন বানিয়ে রেখে দুই ঈদ এলেই লাভের আশায় হলের দ্বার খুলে দেন। যেন কীর্তন শোনা যায়, ‘দ্বার খোল, দ্বার খোল। শাকিব বাবা এসেছেন। আর খান সাহেব কোনো বছরই তাদের আশাহত করেন না। টুকটাক তো দেনই, মাঝে মাঝে ঝুলি ভরিয়ে দেন। এবার তো ঝুলি না, বস্তা ভরে দিয়েছেন। তুফান তু নে তুফান কিয়া ভাই।’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগৎ আর দর্শকদের কাছে নায়ক হিসেবে একমাত্র শাকিব খানই যে ভরসার জায়গা হয়ে রয়েছেন সে কথাই সম্প্রতি একটি পত্রিকায় লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ছটকু আহমেদ।

‘কমপক্ষে ২০০৮ সাল থেকে ঢাকাই চলচ্চিত্র ‘শাকিব’-নির্ভর হয়ে পড়েছে। অথচ আমাদের চলচ্চিত্রের গোড়াপত্তন অর্থাৎ ষাটের দশক থেকেই একাধিক নায়কের ছবি একই সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিয়ে চলত। সর্বশেষ ২০০৮ সালে নায়ক মান্নার মৃত্যুর আগে সালমান শাহ, মান্না, রিয়াজ, ফেরদৌস, ওমর সানী, অমিত হাসান, আমিন খানদের নিয়ে নির্মাতারা চোখ বন্ধ করে ছবি বানাতেন এবং তাদের ছবি দেখতে দর্শক সিনেমা হলে ভিড় জমাত। কিন্তু উল্লিখিত বছরে নায়ক মান্না অকালে মারা যাওয়া ও রিয়াজসহ অন্য নায়করা ধীরে ধীরে অভিনয় থেকে দূরে সরতে থাকেন। এতে তখন থেকেই দেশীয় চলচ্চিত্র শাকিব খানের দখলে চলে যায়। কারণ শাকিবের পাশাপাশি অনেক নায়ক তার আগে-পরে চলচ্চিত্রের অভিনয়ে এলেও খুব একটা দর্শকমন মাতাতে পারেননি তারা।’ এমন মন্তব্য চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাসের। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ছটকু আহমেদ বলেন, এখন যারা অভিনয়ে আসছে তারা শুরুতেই সহজে অর্থবিত্ত আর খ্যাতি পেতে চায়। কেউ অভিনয় শিখেও আসছে না বা শেখার প্রতি কারও আগ্রহও নেই। মূলত এ কারণে নায়ক হিসেবে অনেককে ব্রেক দিলেও শুরুতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে তারা। দর্শক গ্রহণযোগ্যতার অভাবে তাদের নিয়ে আর ছবি নির্মাণ করতে সাহস পান না কোনো নির্মাতা। আরেক খ্যাতিমান সিনিয়র নির্মাতা মতিন রহমানের কথায়- আগে কাজের প্রতি শিল্পীদের যে ডেডিকেশন ছিল তা এখন কোথায়? এর জন্য নির্মাতারাও দায়ী। তারা দায়সারা গোছের কাজ করেন বলে নতুন যারা অভিনয়ে আসছে তারা ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে নতুন নায়ক-নায়িকা আর তৈরি হচ্ছে না। আরেক প্রখ্যাত নির্মাতা কাজী হায়াৎ বলেন, এখন যারা এ অঙ্গনে আসছে তাদের মধ্যে অভিনয়ে পূর্বপ্রস্তুতি কিংবা নায়কোচিত চেহারা ও আচরণ নেই। ফলে দর্শক গ্রহণযোগ্যতার অভাবে এক-দুটি সিনেমার পরই হারিয়ে যায় তারা। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা মালেক আফসারী বলেন, রাজ্জাক, সোহেল রানা, আলমগীর, ফারুক, জসীম, জাফর ইকবাল, নাঈম, ইলিয়াস কাঞ্চন, পরবর্তীতে সালমান শাহ ছিলেন একজন আপাদমস্তক তারকা। সালমানের অকালমৃত্যুর পর মান্না, আমিন খান, ওমর সানী, রিয়াজ, ফেরদৌস, শাকিব খানের ওপরও নির্মাতাদের আস্থা ছিল। তাদের নামেই বড় অঙ্কের টেবিল কালেকশন পাওয়া যেত। এখন আর সেই অবস্থা নেই। চলচ্চিত্রে শিল্পী সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নতুন মুখ খোঁজার অভিযানে নামা হয়েছে বহুবার। অনেক সময় ব্যক্তিগতভাবেও প্রযোজক-পরিচালকরা নতুন মুখের আগমন ঘটিয়েছেন। কিন্তু এ কার্যক্রমগুলো সুষ্ঠু সমন্বয়ের অভাবে কোনো ইতিবাচক ফল দেয়নি ঢাকাই চলচ্চিত্রকে। শিল্পী সংকট কাটাতে এফডিসির ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ নামে একটি প্রতিভা খোঁজার কার্যক্রমের প্রচলন থাকলেও বর্তমানে এটি একটি কর্মশক্তিহীন প্রকল্প। প্রায় এক যুগ আগে ‘সুপার হিরো-সুপার হিরোইন’ নামে একটি প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলো সেখান থেকেও নির্ভরশীল কোনো শিল্পী বের হয়ে আসেনি। চলচ্চিত্রের শিল্পী সংকট কাটাতে ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ নামে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। সুষ্ঠু সমন্বয় না থাকায় এ প্রকল্পও চলচ্চিত্রের জন্য ফলপ্রসূ হয়নি। এদিকে ২০১০ সাল থেকে ঢাকাই চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে আরিফিন শুভ, সাইমন, বাপ্পী, রোশান, সিয়াম, শিপন মিত্র, ইয়াশ রোহান, আদর আজাদ, জয় চৌধুরীসহ বেশ কিছু নতুনের অভিষেক ঘটলেও এদের মধ্যে প্রথমদিকে বাপ্পী, শুভ, সিয়াম কিছুটা স্বস্তি এনে দিলেও তাদের সাফল্যের ধারাবাহিকতা তেমনভাবে আর চোখে পড়ছে না। জাজ মাল্টিমিডিয়ার হাত ধরে বাপ্পীর অভিষেক হওয়ার পর এই প্রতিষ্ঠানের ছবিগুলো তার ক্যারিয়ারের জন্য আশীর্বাদ ছিল। পরে জাজ থেকে বেরিয়ে গেলে বাপ্পী হয়ে পড়েন অ্যাভারেজ নায়ক। সিয়ামও জাজের ‘পোড়ামন টু’, ‘দহন’ দিয়ে আশা জাগালেও শেষ পর্যন্ত ফিকে হয়ে পড়েছেন। আরিফিন শুভর ক্যারিয়ারে একমাত্র প্রাপ্তি ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’, জাজের আরও দুই আবিষ্কার রোশান ও শিপন কোনোভাবেই দাঁড়াতে পারছেন না। তবে সাইমনকে ভাগ্যবান বলা যায়। অভিনয়ের প্রতি তার নিষ্ঠা তাকে ক্যারিয়ারের স্বল্প সময়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা অভিনেতার সম্মান এনে দিয়েছে। এসব শিল্পী ছাড়াও তাদের আগে-পরে আরও অনেকে চলচ্চিত্রে এসেছে। কিন্তু কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও চর্চার অভাবে শুরুতেই শেষ হয়ে গেছে তাদের ‘নায়ক’ তকমা। তাই বলা যায়, ২০০৬ সালে ‘কোটি টাকার কাবিন’ ছবির মহাসাফল্যের পর থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকাই চলচ্চিত্রের গ্রহণযোগ্য নায়ক হিসেবে আশীর্বাদ হয়ে আছেন শাকিব খান। যার প্রমাণ গত কয়েক ঈদে শাকিবের ছবি। সর্বশেষ গত কোরবানির ঈদে মুক্তি পাওয়া শাকিব অভিনীত ‘তুফান’ ছবিটি দেশ ছাড়িয়ে এখন বিদেশের মাটিতে সাফল্যের তাণ্ডব চালাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর