বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

এহতেশামের ‘উত্তম কুমার’ রহমান

এহতেশামের ‘উত্তম কুমার’ রহমান

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও তারকা তৈরির কারিগর খ্যাত চিত্র পরিচালক এহতেশামের আবিষ্কার অভিনেতা রহমান। এহতেশাম তাকে ‘উত্তম কুমার’ নামেই ডাকতেন। অভিনেতা রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে চলচ্চিত্র জগৎ ও তার দর্শক ভক্তরা। ষাটের দশকে চলচ্চিত্রে আসেন তিনি। প্রয়াত এই কিংবদন্তি অভিনেতার স্মরণে তাকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

এহতেশাম তাকে উত্তম কুমার ডাকতেন

এহতেশাম শাহবাগ হোটেলে প্রায়ই আসতেন। তার সঙ্গে রহমানের ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায় অল্প দিনেই। তিনি তাকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য অফার দেন। এহতেশামের অফার পেয়ে তো রহমান আহলাদে আটখানা। তিনি রহমানকে উৎসাহ দিয়ে বলতেন, ‘তুমি দেখতে অবিকল উত্তম কুমারের মতো। তুমিই আমাদের উত্তম কুমার।’

 

রহমান যেভাবে চলচ্চিত্রে

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়ক প্রমথেশ বড়ুয়া ও অভিনেতা অসিত বরণের ভক্ত ছিলেন রহমান। রুপালি পর্দায় প্রিয় শিল্পীদের অভিনয় দেখতে সন্ধ্যা হলেই প্রায়ই ছবিঘরে ছুটে যেতেন। সিনেমা দেখতে দেখতে একসময় চলচ্চিত্রে অভিনয় করার ভূত চেপে বসে তার মনে। কাউকে কিছু না বলেই সিনেমার টানে বাড়ি থেকে লুকিয়ে চলে এলেন ঢাকায়। অজপাড়াগাঁয়ের সেই ছেলেটিই পরবর্তীতে হয়ে গেলেন চলচ্চিত্রের সাড়া জাগানো নায়ক। রহমানকে তুলনা করা হতো নায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে। তার পুরো নাম আবদুর রহমান। তিনি ১৯৩৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার রসেয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ১৯৪৮ সালে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বন্ধুদের সঙ্গে হইচই করা, মাঠে ফুটবল খেলা, নয়তো ক্রিকেট খেলে বিকাল পার করতেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে নামাজ পড়ে পড়াশোনায় বসে যেতেন। এই বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন রহমান। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হলেন তিনি। সিট পেলেন কলেজ হোস্টেলে। তখন রাজশাহীতে ছিল ‘কল্পনা’ ও ‘অলোকা’ ছবিঘর। সন্ধ্যা হলে প্রায়ই ছবি দেখার জন্য ছবিঘরে আসতেন। প্রমথেশ বড়ুয়া নয়তো অসিত বরণের ছবি তার খুব ভালো লাগত। বিকালে বেড়াতে যেতেন পদ্মা নদীর তীরে। মন টিকল না রাজশাহীতে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা না দিয়েই চলে এলেন ঢাকায়। জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হলেন। এখান থেকে আই এ পাস করলেন। ১৯৫৮ সালে শাহবাগ হোটেলে চাকরি নেন। ইংরেজি ও হিন্দি ছবি মুক্তি পেলে হলে গিয়ে দেখতেন। সুচিত্রা- উত্তমের সাগরিকা, শাপমোচন, শিল্পী ছবি দেখে চলচ্চিত্র জগতের প্রতি আগ্রহটা বেড়ে যায়। তখন থেকেই ফিল্মে অভিনয় করার শখ ভালো করে চেপে বসে মাথায়। জীবদ্দশায় এক সাক্ষাৎকারে রহমান বলেছিলেন, ১৯৫৮ সালে শাহবাগ হোটেলে রিসিপশনিস্টের চাকরি করি। সেখানে আমাকে কয়েকজন বন্ধু ঠাট্টা করে উত্তম উত্তম বলে ক্ষ্যাপাত। একদিন আমার একজন বন্ধু এসে বলল, আমাদের এখানে ছবি তৈরি হবে সেখানে সুযোগ পেতে পারিস। বন্ধুদের কথামতো গেলাম সেই অফিসে। পরিচালকের নাম ফজলুল হক। ছবির নাম ‘আজান’। রমনা পার্কের পশ্চিমে টেনিস গ্রাউন্ডের সঙ্গে ছোট একটা রুমে অফিস। পরিচালক হক সাহেবের স্ত্রী আমাকে দেখে বললেন, ‘আমি মনে মনে নায়কের ভূমিকায় যে রকম মুখ খুঁজছিলাম ঠিক সেই রকম ছেলে আল্লাহ পাঠিয়েছে। আর কোনো কথা নয়। এই ছেলেই নায়ক চরিত্রে অভিনয় করবে।’ সে দিনই আমাকে নায়ক চরিত্রে নির্বাচন করলেন হক সাহেব। তখন আমার বয়স ২১ বছর। তবে আমার উচ্চারণে কিছুটা সমস্যা ছিল। তাই বিরোধিতা করেছিলেন অভিনেতা ইনাম আহমেদ। সেদিন যে আমাকে উৎসাহ, অভয়, সাহস ও সহযোগিতা করেছিল তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় চিত্রগ্রাহক মরহুম সাধন রায়। ‘আজান’ ছবির শুটিং শুরু হতে বিলম্ব হওয়ায় এরই মধ্যে এহতেশামের ‘এদেশ তোমার আমার’ এ অভিনয় করার সুযোগ পাই।

 

ছবির সেট থেকে পালাতে চেয়েছিলেন

এহতেশাম পরিচালিত ছবি ‘এদেশ তোমার আমার’ এ রহমান ছিলেন প্রতিনায়ক। নায়ক-নায়িকা আনিস (খান আতা) ও সুমিতা দেবী। প্রথম দিন শুটিংয়ে অংশ নিয়ে অভিনয় করতে পারছিলেন না। বারবার ঘাবড়ে যাচ্ছিলেন। এ অবস্থা দেখে খান আতা বললেন, এহতেশাম এই ছেলেটাকে কোথা থেকে ধরে নিয়ে এসেছেন। এ কথা শুনে রহমান শুটিং স্পট থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তার একটু আসি কথাটি শুনে সন্দেহ হয় সেটের সবার। রহমান পালিয়ে যেতে পারলেন না। ‘এদেশ তোমার আমার’ মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে। এ ছবিটি হিট হয় একই সঙ্গে রহমানের অভিনয় প্রশংসিত হয়।

 

শবনমের সঙ্গে কিংবদন্তি জুটি

পঞ্চাশের দশক থেকে ওপার বাংলার চলচ্চিত্রে সাড়া জাগিয়ে দর্শকমন তোলপাড় করছেন উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন জুটি। তাদের মুগ্ধতা এপার বাংলার দর্শকদেরও মাত করে রেখেছে। এমন একটি সময়ে ঢাকাই ছবিতে কোনো জনপ্রিয় জুটি গড়ে ওঠেনি। অবশেষে ষাটের দশকে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এদেশের চলচ্চিত্রের তারকা তৈরির কারিগর খ্যাত দুই সহোদর নির্মাতা এহতেশাম-মুস্তাফিজ জুটির হাত ধরে এলেন দুই নতুন মুখ। রহমান-শবনম। মুস্তাফিজের ‘হারানো দিন’ ছবিতে প্রথম শবনম-রহমান জুটি বেঁধে অভিনয় করেন। এই চলচ্চিত্রে ‘মালা’ চরিত্রে শবনম আর ‘কামাল’ চরিত্রে রহমান। ছবিটি ১৯৬১ সালে মুক্তি পায়। এ ছবির মাধ্যমে রহমান-শবনম জুটি তখন খ্যাতির তুঙ্গে। ঠিক সেই সময়ে তাদের উর্দু ছবিতে কাস্ট করলেন এই পরিচালক ভ্রাতৃদ্বয়। এ জন্য রহমানকে কিছুদিন উর্দু শিখতে হলো। ১৯৬২ সালে এহতেশামের ‘চান্দা’ আর ১৯৬৩ সালে মুস্তাফিজের ‘তালাশ’ ছবিতে অভিনয় করে এ জুটি আরও হিট হয়ে গেল। ওপার বাংলার উত্তম-সুচিত্রার মতো এপার বাংলায় কিংবদন্তি হয়ে গেলেন শবনম-রহমান জুটি।

 

যেভাবে পা হারালেন রহমান

‘প্রীত না জানে রীত’ ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে শুটিং করার জন্য রহমান গেলেন সিলেটে। এই ছবিতে অভিনয় করতে গিয়েই রহমান এক পা হারালেন। সেদিন সিলেটে জিপগাড়ি চালাচ্ছিলেন আফজাল হোসেন। পাশে মোহসীন নজরুল বসা। রহমানের এক পা ছিল বাইরে। মুরারী চাঁদ কলেজের সামনে আসতেই একটি ট্রাক এসে রহমানের এক পা কেড়ে নিল।

 

রহমানের অন্য যত হিট ছবি

১৯৬৫ সালের ১৬ এপ্রিল মুক্তি পায় ‘বাহানা’। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জহির রায়হান ছবিটি নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্র ব্যাপক জয়প্রিয়তা এনে দেয় নায়ক রহমানকে। তার আগের চলচ্চিত্র ‘মিলন’ ব্যাপক জয়প্রিয় ছিল তৎকালীন দুই পাকিস্তানে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন। সেখানে নায়ক রহমান চুনি লালের চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯৮১ সালে দিলীপ বিশ্বাস পরিচালিত ‘অংশীদার’ চলচ্চিত্রেও তিনি দুর্দান্ত অভিনয় করেন। রহমান অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র ছিল অশোক ঘোষ পরিচালিত নব্বইয়ের দশকে মুক্তি পাওয়া ‘আমার সংসার’।

 

নির্মাতা হিসেবেও সফল

অভিনয়ের পাশাপাশি রহমান বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম নায়ক, যিনি ক্যামেরার পেছনে দাঁড়ানোর সাহস দেখান। ১৯৬৭ সালে ‘দরশন’ চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে পরিচালনায় আসেন তিনি। ‘দরশন’ আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পায়। এ ছবিতেও তার নায়িকা ছিলেন শবনম। রহমান পরিচালিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো- ‘মিলন’, ‘কঙ্গন’, ‘জাঁহা বাজে সেহনাই’, ‘নিকাহ’ প্রভৃতি।

 

এক নজরে রহমান

বাংলা, উর্দু ও পশতু ভাষার চলচ্চিত্রে সমানভাবে জনপ্রিয় অভিনেতা রহমান অভিনীত চলচ্চিত্রগুলো হলো- উর্দুতে ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘মিলন’, ‘বাহানা’, ‘ইন্ধন’, ‘দরশন’, ‘জাঁহা বাজে সেহনাই’, ‘গোরি’, ‘প্যায়াসা’, ‘কঙ্গন, ‘দোস্তি’, ‘নাদান’; বাংলায় ‘এদেশ তোমার আমার’, ‘রাজধানীর বুকে’, ‘এই তো জীবন’, ‘হারানো দিন’, ‘যে নদী মরু পথে’, ‘দেবদাস’। রহমান ছিলেন পাঁচ কন্যার জনক। তিন কন্যা আমেরিকা প্রবাসী, এক কন্যা লন্ডনে এবং সর্বকনিষ্ঠ কন্যা থাকেন ঢাকায়। শেষ জীবনে ঢাকাতেই কাটে তার অসুস্থ জীবন। হুইল চেয়ারই হয় তার চিরসঙ্গী। এই অসুস্থ কিংবদন্তি অভিনেতার খবর নিতেন না চলচ্চিত্রে কেউ। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাসসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন রহমান। ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই ঢাকায় এই কিংবদন্তি দাপুটে অভিনেতার জীবনাবসান ঘটে। চলচ্চিত্রামোদীদের হৃদয়ে চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের উত্তম কুমার খ্যাত অভিনেতা রহমান।

সর্বশেষ খবর