মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

আমি হয়ে গেলাম ডার্লিং অব দ্য ফেস্টিভ্যাল : ববিতা

আমি হয়ে গেলাম ডার্লিং অব দ্য ফেস্টিভ্যাল : ববিতা

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতার জন্মদিন আজ। বাংলা ছবির বিশ্বজয়ে একসময় তিনি ছুটে বেড়িয়েছিলেন বুড়িগঙ্গা থেকে ভলগা হয়ে বিশ্বের আনাচে-কানাচে। সবাইকে জানিয়েছিলেন- ববিতা বাংলাদেশের মেয়ে, এসেছি বাংলা ছবির বিশ্বজয়ে। সবাই সাদরে গ্রহণ করল এ দেশের ছবি আর ববিতাকে। জন্মদিনে এ কিংবদন্তি অভিনেত্রীকে নিয়ে লিখেছেন  - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

চলচ্চিত্রে যাত্রার গল্প...

ববিতা বলেন, চলচ্চিত্রে আমার যাত্রার গল্পের শেষ নেই, মাত্র ১৩ বছর বয়সে পুতুল খেলার সময় অভিনয়ে এসেছি। ১৯৬৮ সাল। শ্রদ্ধেয় নির্মাতা জহির রায়হানের উৎসাহে ‘সংসার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু। এতটুকু বয়সে বেশি কিছু বোঝার কথা নয়। তারপরও একটি বিষয় আমাকে খুব ভাবাত, ভোগাত। তখন দেশ স্বাধীন হয়নি। এ দেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। এখানে তখন শিল্পমানের ছবি নির্মাণ হতো। সেগুলো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ পেত না। আমন্ত্রণ জানানো হতো পশ্চিম পাকিস্তানের ধুম-ধাড়াক্কা বাণিজ্যিক ছবিগুলোকে। আমার ছোট্ট মনে বাংলা ছবির প্রতি এ অবজ্ঞা খুব কষ্ট দিত। এক সময় দেশ স্বাধীন হলো। এ বন্ধ্যত্ব কাটল। এ দেশের ছবি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসার ঝড় তুলতে শুরু করল। পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে অনঙ্গ বউ চরিত্রে আমাকে কাস্ট করলেন। ছবিটি আন্ত-র্জাতিক অঙ্গনে ঝড় তুলল। ছবিটি নিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করলাম। বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে ছুটে গেলাম বুড়িগঙ্গা থেকে ভলগা হয়ে বিশ্বের আনাচে-কানাচে। সবাইকে জানালাম ববিতা বাংলাদেশের মেয়ে, এসেছি বাংলা ছবির বিশ্বজয়ে। সবাই সাদরে গ্রহণ করল এ দেশের ছবি আর ববিতাকে। রাশিয়ায় তখন বলিউড অভিনেতা রাজকাপুরের জয়জয়কার। বিমানবন্দর থেকে সব জায়গায় তাঁর ছবি ব্লোআপ হতো। একসময় অবাক চোখে দেখলাম রাজকাপুরের ছবির পাশে ববিতার ছবি স্থান করে নিয়েছে। মানে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের সম্মানজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। বিশ্বের জনপ্রিয় পত্রিকাগুলো গুরুত্ব দিয়ে আর্টিক্যাল তৈরি করল সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা ববিতাকে নিয়ে। বিশ্বের প্রধান চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে আমি হয়ে গেলাম ডার্লিং অব দ্য ফেস্টিভ্যাল। ফেস্টিভ্যালের ওপেনিং আর ক্লোজিং হতো আমার হাতে। পৃথিবীর খ্যাতনামা ইউনিভার্সিটিগুলোতে বক্তব্য রাখতে হয়েছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অগণিত স্বীকৃতি এবং দর্শক-ভক্তের ভালোবাসায় আমি দেশ, জাতি এবং চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।

 

গেন্ডারিয়ায় ববিতা গলি

বাবার চাকরি সূত্রে ছোটবেলায় বাগেরহাটে থাকতেন ববিতা। পৈতৃক বাড়ি যশোর জেলায়।  বড় বোন সুচন্দার  চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সূত্রে পরিবারসহ চলে আসেন ঢাকায়। গেন্ডারিয়ার বাড়িতে শুরু হয় কৈশোরের অবশিষ্টাংশ। এখানে তিনি মনিজা রহমান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ববিতা বলেন, গেন্ডারিয়ার বাড়িতে থাকতেই অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হই। সবচেয়ে মজার স্মৃতি হলো এ বাড়িতেই কলকাতার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের চিঠি আসে আমাকে উনার ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য। পরবর্তীতে আমার স্থানীয় ভক্তরা গেন্ডারিয়াকে ববিতা গলি নামে নামকরণ করেন। ভক্তদের এ ভালোবাসায় আমি আপ্লুত, ধন্য।

 

যেভাবে ববিতা হলাম

‘সংসার’-এর বছর দুয়েক পর জহির রায়হানের পরের ছবি ‘জ্বলতে সুরজ কি নিচে’তে কাজ করি। ছবির প্রযোজক বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান আফজাল চৌধুরী আর তাঁর স্ত্রী মিলে আমার নাম দিলেন ববিতা।

 

প্রথম নায়িকা যে ছবিতে

সংসার ছবির পর জহির রায়হান আমাকে প্রথমবারের মতো নায়িকা করে ‘শেষ পর্যন্ত’ নির্মাণ করলেন। এ ছবির নায়ক ছিলেন রাজ্জাক ভাই। আমার পর্দাজীবনের প্রথম নায়ক তিনি। ছবিটি ১৯৬৯ সালের ১৪ আগস্ট মুক্তি পায়। সেই থেকে ‘নায়িকা ববিতা’র যাত্রা শুরু। ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবির পারিশ্রমিক পেয়েছিলাম ১২ হাজার টাকা। ওই টাকা দিয়ে গাড়ি কিনেছিলাম। ইচ্ছা ছিল মাকেই প্রথম গাড়িতে চড়াব। সেই ভাগ্য আর আমার হলো না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছবিটি মুক্তির দিনই মা মারা গেলেন।

 

শিশুদের নিয়ে কাজ করতে পেরে গর্বিত

আন্তর্জাতিক শিশু সাহায্য সংস্থা ডিসট্রেস চিলড্রেন অ্যান্ড ইনফান্টস ইন্টারন্যাশনাল (ডিসিআইআই) ২০১২ সালে আমাকে শুভেচ্ছা দূত মনোনীত করে। তখন থেকে বিশ্বব্যাপী সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও তাদের পরিবারের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি। বিশ্বের সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও তাদের পরিবারের কল্যাণে নিজেকে যুক্ত করতে পেরে গর্ববোধ করছি। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও তাদের দুঃখ-কষ্ট মোচন করা সবারই দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ দায়িত্ব আজীবন পালন করে যেতে চাই।

 

এখন প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস

ছোটবেলা থেকে প্রকৃতি আমাকে খুব কাছে টানে। মনে হয় যেন ইশারায় শিস দিয়ে ডাকছে। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বারবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যাই। একসময় ভাবলাম প্রকৃতিকে নিজের ঘরে নিয়ে এলে কেমন হয়? ইট, কাঠের এ শহরে নৈসর্গিক প্রকৃতির দেখা চাইলেই তো আর মিলবে না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগে যখন-তখন গ্রামগঞ্জেও ছুটে যেতে পারি না। এ ভাবনা থেকে নিজের ঘরেই গড়ে তুলেছি এক অপরূপ নৈসর্গিক পরিবেশ। চমৎকার ফুল, ফল আর সবজির বাগান। সঙ্গে আছে হরেকরকম পাখি। আমার গুলশানের বাড়ির ছাদ যেন এখন এক স্বর্গীয় সুখের আধার। চারদিকে রং বেরঙের ফুলের মহাসমারোহ। সঙ্গে আছে পাখির কলতান। সব মিলিয়ে চোখ জুড়ানো পরিবেশ। গাছের প্রতি আমার এ ভালোবাসা বংশগত। বাবার হাতে গাছ বেশ ভালো হতো। তিনি যেখানে যেতেন সঙ্গে করে গাছ নিয়ে আসতেন। তা দেখে সেই একরত্তি বয়স থেকেই প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যাই। মেয়েরা শপিংয়ের প্রতি দুর্বল হয়। আমি কিন্তু দেশে-বিদেশে প্রথমে খবর নেই কোথায় নার্সারি আছে। ফুল-ফলের গাছ সংগ্রহ করি। এগুলো আমার কাছে শাড়ি-চুড়ি-গহনার চেয়েও অনেক দামি। ফজরের নামাজ পড়ে ছুটে যাই বাগানে। নিজ হাতে পরম মায়ায় প্রিয় গাছের যত্ন নেই। বিকালে যখন বাগানে পায়চারি করতে যাই তখন আমার প্রিয় টিয়া পাখিটি এসে আমার কাঁধে না হয় মাথায় বসে। আমার সব কথা বোঝে আর শোনে। যে গাছটিকে অতি যতেœ বড় করে তুলি সে আমাকে সুন্দর ফুল দিয়ে মুগ্ধ করে। আমার সব একাকিত্ব দূর করে দেয়। পরমানন্দে সময় কেটে যায়...।

 

আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও সম্মাননা

বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে সবচেয়ে বেশিবার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং পুরস্কৃত হয়েছেন ববিতা। তিনি প্রায় ৩০০ ছবিতে অভিনয় করেছেন। বাদী থেকে বেগম (১৯৭৫), নয়নমনি (১৯৭৬), বসুন্ধরা (১৯৭৭), রামের সুমতি (১৯৮৫) এবং পোকামাকড়ের ঘরবসতি (১৯৯৬) ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে ‘হাছন রাজা’, ‘খোদার পরে মা’ ও ‘কে আপন কে পর’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার এবং সর্বশেষ জাতীয় পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা লাভ করেন। তাঁর অভিনীত সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি নারগিস আক্তারের ‘পুত্র এখন পয়সাওয়ালা’ (২০১৫)। নিজের প্রযোজনা সংস্থা ববিতা মুভিজ থেকে নির্মাণ করেছেন ‘ফুলশয্যা’, ‘আগমন’, ‘পোকামাকড়ের ঘর বসতি’র মতো জনপ্রিয় ও জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত ছবিগুলো। পোকামাকড়ের ঘরবসতি ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ প্রযোজকের জাতীয় পুরস্কারও পান তিনি। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত অশনি সংকেত (১৯৭৩) চলচ্চিত্রে ‘অনঙ্গ বৌ’ চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক শিল্পীর মর্যাদা লাভ করেন। ১৯৫৩ সালের ৩০ জুলাই যশোরে ববিতার জন্ম। পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় তাঁর বেড়ে ওঠা। প্রকৃত নাম ফরিদা আক্তার পপি। ববিতার একমাত্র ছেলে অনিক কানাডায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স শেষ করে বর্তমানে সেখানে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন।

সর্বশেষ খবর