শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

সহিংসতার বিরুদ্ধে শিল্পীরা

পান্থ আফজাল

সহিংসতার বিরুদ্ধে শিল্পীরা

ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরকার পতনের পরও সারা দেশে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা চত্বর, ঐতিহ্য স্থাপনা নির্বিচারে ভাঙচুর ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে সাতটির মতো থিয়েটার দল পুড়িয়ে দেওয়ার খবরও রয়েছে। তাই শিল্প, স্থাপনা ও শিল্পাঙ্গন ধ্বংসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। অন্যদিকে এমন ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন ঢাকাই শোবিজের অনেক শিল্পীও। তারা সহিংসতা বন্ধ ও দেশের সব মানুষকে শান্ত থাকার জন্যও আহ্বান জানিয়েছেন। নিজে মুক্তিযোদ্ধা হয়েও কোটার বিরুদ্ধে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছাত্রদের পক্ষে কথা বলেছেন চিত্রনায়ক সোহেল রানা। তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের রক্ত বৃথা যায়নি। শিক্ষার্থীদের রূপরেখা চূড়ান্ত হওয়ার পরই বিস্তারিত বলা যাবে। টুকটাক কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে- এটা স্বাভাবিক। যখন কোনো গণঅভ্যুত্থান হয় এসব ছোটখাটো ঘটনা ঘটেই। এ অবস্থা থাকবে না। সবাই আমরা শান্তির পক্ষে। আগামীতে আমাদের মিলেমিশে কাজ করতে হবে।’ ছাত্রদের আন্দোলনের প্রথম থেকে মাঠে ছিলেন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন। তিনি এ সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমি সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু বর্তমান সহিংসতা নিন্দনীয়। এ বিপ্লব অযৌক্তিক আক্রমণের কারণে কলঙ্কিত হতে দেওয়া যাবে না।’ বরেণ্য অভিনেতা আবুল হায়াত বলেন, ‘সফল এই দেশ গঠনের আন্দোলনে শিক্ষার্থী-জনতা যারা ছিল, সবাই আমাদের অহংকার। এই যে শত শত প্রাণের বিনিময়ে ২০২৪-এ আবার স্বাধীনতা পেলাম, এটা যেন আর নষ্ট না হয়। এবার যেন যুক্তিযুক্তভাবে সবকিছু ব্যবহার করতে পারি। কারণ, এর পেছনে আমাদের এবারও রক্ত ঝরাতে হয়েছে। আমরা আর কোনো নৃশংসতা চাই না। আমরা স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে চাই। আবার বলার স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা, পড়ার স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতাকে কেউ যেন ভণ্ডুল না করে।’ এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে শৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে সোশ্যাল হ্যান্ডেলে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নুসরাত ইমরোজ তিশা বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়ন করুন এবং দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনুন।’ নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘বিজয়ের আনন্দ অবশ্যই করব! কিন্তু এখন সময় সংযমেরও, চোখ কান খোলা রাখার। আমরা ২০ বছর প্রতিহিংসার রাজনীতি দেখেছি। প্রতিহিংসার উত্তর দেব আমরা কাইন্ডনেস এবং এমপ্যাথি দিয়ে।’ উপস্থাপক হানিফ সংকেত একটি গণতান্ত্রিক সরকার দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেন, ‘কখনোই ছাত্রদের আন্দোলন পরাজিত হয়নি। এবারও ছাত্ররা সেটা প্রমাণ করে দেখিয়েছে। এ দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি গণতান্ত্রিক সরকার দেখতে চাই, যা হবে নিরপেক্ষ দুর্নীতিমুক্ত। যাদের মাধ্যমে আমরা একটি সুন্দর বাংলাদেশ পাব।’ ছাত্রদের আন্দোলনে সরব ছিলেন সংগীত পরিচালক ও গীতিকার প্রিন্স মাহমুদ। তিনি দেশবাসীকে স্থির থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘কোনোভাবেই যেন ছাত্রদের এমন বিজয়ে কালিমা লেপন কেউ না করতে পারে। যদি সবাই সহযোগিতা করি সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি, কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত না হই আগামীর পুলিশ হবে স্বাধীনতা পরবর্তী সবচেয়ে মানবিক পুলিশ। আসুন আমরা ধৈর্য ধরি, সংযমী হই, মানবিক হই।’ পরীমণি বলেন, ‘আমরা সংযত হই, দায়িত্ববান হই। প্রিয় বাংলাদেশে আর রক্তপাত চাই না।’ রাজপথে গিয়ে সরাসরি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন মোশাররফ করিম, নাজিয়া হক অর্ষা, সিয়াম আহমেদ, জাকিয়া বারী মম, আজাদ আবুল কালাম, সাবিলা নূর, ইমতিয়াজ বর্ষণ, আশফাক নিপুণ, আরশ। এসব শিল্পী ছাত্রদের বিজয়ের পর দেশবাসীকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে সব ধরনের সহিংসতা পরিহার করে সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার কথা বলেছেন। সম্প্রতি ভাঙচুরের শিকার স্টার সিনেপ্লক্সেসহ বেশ কয়েকটি সিনেমা হল। এ নিয়ে সিয়াম লিখেছেন, ‘স্টপ ইট। স্টপ ইট নাও। আমরা সবাই মিলে যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি সেখানে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা আরও সুন্দর হবে এটাই কামনা ছিল। তবে কেন রাহুল আনন্দদা’র বাড়িতে হামলা হলো, বগা তালেবের বাড়িতে হামলা হলো? কেন রাজশাহী সিনেপ্লেক্সের এই হাল? কেন রুটস সিনেক্লাবের ২ কোটি টাকার ক্ষতি হলো? কারা করছে এ কাজগুলো? চলুন আমরা সবাই মিলে রুখে দেই এ অপশক্তিদের। ফ্যাসিবাদের বিকল্প হিসেবে ফ্যাসিবাদকে না এনে নতুন এক বাংলাদেশ গড়ি। আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ।’ জাকিয়া বারি মম ছাত্রদের এ বিজয়কে পুরো দেশের বিজয় বলেই অভিহিত করেছেন। সেই সঙ্গে আহ্বান জানিয়েছেন কেউ যেন তাদের এ বিজয়কে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে কলুষিত না করেন। এদিকে বিজয়-পরবর্তী সহিংসতায় জলের গানের গায়ক রাহুল আনন্দের ঘরবাড়িসহ নিজ হাতে বানানো অসংখ্য বাদ্যযন্ত্র পোড়ানো নিয়ে নিন্দা প্রকাশ করেছেন বন্যা মির্জা। রাহুলের পক্ষে কথা বলতে শিল্পী সমাজকে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যেন সবাই সহকর্মীদের পাশে থাকি। আমরা কেউ আলাদা নই। আমাদের নানা মত থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। রাহুলের সঙ্গে যা হলো সেটা নিয়ে কথা বলুন। সবাই বলুন। সব অমানবিকতার বিরুদ্ধে কথা বলুন। কেউ টিজ করলে কেউ তার উত্তর করবেন না, টিজ করার ক্ষতি আমরা দেখছি। সামান্য একটা বাক্যে যা মেটানো যেত সেটা না হওয়ায় কেবল তাচ্ছিল্যের কারণে আমরা এখানে। নিজেরা নিজেদের গালি দেবেন না দয়া করে।’ এদিকে রাহুল আনন্দের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় এরই মধ্যে প্রতিবাদ করেছেন শিরোনামহীন ব্যান্ডের দলনেতা জিয়া, সংগীত পরিচালক ইমন চৌধুরী, শিল্পী তরুণ মুন্সী, থিয়েটার বাতিঘর, প্রাচ্যনাট, আরণ্যক প্রমুখ। অন্যদিকে ‘শিল্প, স্থাপনা ও শিল্পাঙ্গন ধ্বংসের বিরুদ্ধে অবস্থানের ব্যানারে মঙ্গলবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সামনে রাহুল আনন্দের শিল্পীসঙ্গীরা কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় তারা গান গেয়ে ও হাতে নানা ধরনের পোস্টার নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিল্পকর্ম ভাঙচুর ও সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদ করেন। পরে তারা গানের মিছিল নিয়ে শিল্পকলা থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাব যান। এক বিবৃতিতে অতি দ্রুত দেশের জনগণের সুরক্ষা এবং সহিংসতা বন্ধের জন্যও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান শিল্পীরা।

সর্বশেষ খবর