‘মানুষ মানুষের জন্য’, মানব জীবনের নানা ক্রান্তিলগ্নে মানুষ মানুষেরই পাশে এসে দাঁড়াবে এটিই বড় মানব ধর্ম। যুগে যুগে তাই-ই হয়ে আসছে। বর্তমানে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে চলছে বন্যার করালগ্রাস। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে লাখ লাখ মানুষ হয়ে পড়েছে বিপদগ্রস্ত, নিঃস্ব। তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সর্বস্তরের মানুষ। সংগীত শিল্পীরাও বাদ যায়নি। গানে গানে তারা বন্যাদুর্গতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বিষয়টি তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

তৈরি হলো গান। ‘বানভাসি জীবন’ শিরোনামের গানটি তারেক আনন্দের কথায় সুর, সংগীত ও কণ্ঠ দিয়েছেন শাহরিয়ার রাফাত। রাফাত বলেন, ‘গানের কথা পাওয়ার পরই সুরে ডুবে যাই। খুব বেশি সময় লাগেনি। মাত্র এক দেড় ঘণ্টায় গানটির সুর-সংগীত করেছি। আমি চেষ্টা করেছি গানের বাণী যাতে করে মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায় এমন সুর করতে।’ গীতিকার তারেক আনন্দ বলেন, ‘হাতে হাত ধরে দুঃসময় করব পার, তোমাদের কষ্টগুলো আমাদের সবার’। এটি গানের ব্রিজ লাইন। আমার আর কথা নাই। যারা এ মুহূর্তে কষ্টে আছে তাদের কষ্টের ভাগ আমরাও নিয়ে নিলাম। বানভাসি মানুষের ক্ষত দ্রুত কেটে উঠুক।’ গীতিকার ও শিল্পী জানান, এই গান কপিরাইট ফ্রি, উন্মুক্ত। এখান থেকে সামান্য আয় যদি আসে আর সেটি বানভাসি মানুষদের কাছে পৌঁছে দেবেন। গানটি প্রকাশ হয়েছে শিল্পী শাহরিয়ার রাফাত ও গীতিকার তারেক আনন্দের ফেসবুক এবং ইউটিউব চ্যানেলে।

টিএসসিতে সংগীতানুষ্ঠান

ঢাবির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বানভাসি মানুষের সহায়তায় আয়োজিত সংগীতানুষ্ঠানে গান শোনান শাহনেওয়াজ তুষার। এতে আরও পরিবেশিত হয় বিভিন্ন ব্যান্ড দলসহ একক কণ্ঠের গান। নানা বয়সি মানুষ কণ্ঠ মেলাচ্ছিলেন মঞ্চে পরিবেশিত গানের সুরে। গান নিয়ে এমন উৎসবমুখরতার উল্টোপিঠে দেখা গেল ভিন্ন এক দৃশ্য। সেই দৃশ্যকল্পে মিশেছিল মানবতার মর্মবাণী। পরিবেশনা পর্বে বাধা-বিপত্তিহীন সীমানা ছাড়ানো নদীর গান শোনায় ব্যান্ডদল মাভৈ। এই সংগীত দল পরিবেশিত গানের শিরোনাম ছিল- পুবের পাহাড়ে বরাদ নদীর দুই ধারে/অসমিয়া সহোদরারে মণিপুরী সহোদরারে....। অনিন্দ্য ঘোষ শুনিয়েছেন- একটি গানের জন্য পথে পথে গাই/তবু এই শহরে গান শোনার কেউ নাই...। শাহনেওয়াজ তুষারের গাওয়া গানের শিরোনাম ছিল ‘হঠাৎ করে ঘটতে পারে অদ্ভুত ঘটনা’। ব্যান্ড দল মঞ্চগান পরিবেশিত গানের শিরোনাম ছিল ‘মরব বলে বাঁচতে এসেছি’। এ ছাড়া সংগীত পরিবেশন করে ব্যান্ড দল সমগীত, শিরোনামহীন, কাকতাল, মাদল, গঞ্জে ফেরেশতা, বেতাল, ডেমোক্রেজি ক্লাউন, প্রহরী দি পোয়েট্রি ব্যান্ড ও নথসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

গেট আপ স্ট্যান্ড আপ

দেশের চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছে সংগীত শিল্পীদের উদ্যোগ ‘গেট আপ স্ট্যান্ড আপ’। গেট আপ স্ট্যান্ড আপের কার্ডটি ফেসবুকে পোস্ট করেছে আর্টসেল, শিরোনামহীন, আরবোভাইরাস, নেমেসিস, সোনার বাংলা সার্কাস, হাইওয়েসহ আরও কয়েকটি ব্যান্ড। বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে গেট আপ স্ট্যান্ড আপের তরফ থেকে ফান্ড সংগ্রহ করা হচ্ছে।

রাবি শিক্ষার্থীরা

রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন স্থানে গণগান গেয়ে বন্যা কবলিত এলাকার বানভাসি মানুষের জন্য টাকা উত্তোলন করছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাংস্কৃতিক কর্মীরা। গত রবিবার বিকাল ৩টায় রাজশাহীর মুক্তমঞ্চে গান পরিবেশনা করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় গান গেয়ে মোটা অঙ্কের তহবিল সংগ্রহ করেন তারা। এর আগেও দুই দিন গান পরিবেশন করে তহবিল সংগ্রহ করেন তারা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহীর সাংস্কৃতিক কর্মীরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে রাজশাহীজুড়ে গান পরিবেশনা করছেন।

পথে পথে গাইছে নাটোরের শিল্পীরা

পথে পথে গান গেয়ে বানভাসিদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করছেন স্থানীয় শিল্পীরা। শুক্রবার বিকালে উপজেলার বিলশা বিনোদন এলাকায় গান গেয়ে বানভাসিদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছেন স্থানীয় শিল্পীরা। তবে এরা কেউ-ই পেশাদার শিল্পী নন, শখের বসে গান চর্চার পাশাপাশি নাটোরের গুরুদাসপুরে নানা অনুষ্ঠানে গান গেয়ে থাকেন তাঁরা। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার স্বরলিপি শিল্পী গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মঈনুল ইসলাম দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আইয়ুব বাচ্চু ফাউন্ডেশন

প্রয়াত কিংবদন্তি ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চুর ফাউন্ডেশন থেকেও বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ পাঠানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে আর্টসেল

বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ তহবিল গঠন করতে দেশের বাইরেও হচ্ছে কনসার্ট। জনপ্রিয় ব্যান্ড দল আর্টসেল ২৫ বছরপূর্তি উদযাপন করছে। এর মধ্যে তারা অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা ট্যুর সম্পন্ন করেছে। এবার আমেরিকায় করবে বেশ কয়েকটি কনসার্ট। দলটির পক্ষ থেকে গতকাল জানানো হয়, আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে শো করে যে পারিশ্রমিক তারা পাবেন, তার একটা অংশ বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে আয়োজকদের নিয়েও ফান্ড তোলার জন্য কাজ করবে তারা।

ঢাবিতে কনসার্ট

শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাদদেশে জরুরি সংযোগ কনসার্টের আয়োজন করা হয়। অংশ নেন শিরোনামহীন, ফারজানা ওয়াহিদ সায়ানসহ ৩০টি ব্যান্ড ও শিল্পীরা। এই কনসার্ট থেকে আয়কৃত ২১ লাখ নগদ টাকা ও ২০ ট্রাক ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয় বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায়।

বামবা

বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন [বামবা] আয়োজন করেছে ‘মুক্তি কনসার্ট’-এর। ৩১ আগস্ট আয়োজিত এই কনসার্ট থেকে পাওয়া অর্থ ব্যয় করা হবে বন্যার্তদের সহযোগিতায়।

সংগীতশিল্পী সালমা

সংগীতশিল্পী সালমা ঘোষণা করলেন রের্কডিং করা গানের অর্থ পুরোটাই বন্যার্তদের দেবেন তিনি। বন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তার এই প্রয়াস চলবে বলেও জানান সালমা। অর্থাৎ বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসা পর্যন্ত তিনি যতগুলো গান রেকর্ড করবেন সবগুলোর অর্থই যাবে বন্যার্তদের মাঝে।

জরুরি সংযোগ কনসার্ট

বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ ও অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে আয়োজন করা হয় ‘জরুরি সংযোগ’ শিরোনামের কনসার্ট। এতে শিরোনামহীন, সোনার বাংলা সার্কাস, এফ মাইনর, অর্ঘদেব, কৃষ্ণকলি, সায়ানসহ ৩০টির মতো ব্যান্ড ও শিল্পী গান পরিবেশন করছেন। বিনা পারিশ্রমিকে শিল্পীরা এ কনসার্টে পারফরম করেন। এখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ বন্যার্তদের সহায়তায় পাঠানো হচ্ছে। এ ছাড়া সরাসরি বন্যার্ত এলাকায় প্রয়াজনীয় দ্রব্যসামগ্রীসহ রেসকিউ করতে গিয়েছেন অনেক তারকা-নির্মাতা।

‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’

দুর্গম গিরি কান্তর মরু, দুস্তর পারাবার হে/ লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিতে যাত্রীরা হুঁশিয়ার-জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই বিপ্লবী গানটি নতুন করে গাইলেন পান্থ কানাই, অনিমেষ রায় ও সৈয়দ সুজন। নিতাই ঘটকের আদি সুরে এর সংগীত পরিচালনা করেছেন সৈয়দ সুজন। দেশজুড়ে হঠাৎ বন্যায় লাখো মানুষ যেভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েছে এবং তাদের উদ্ধার করতে অন্যরা যেভাবে চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে এসেছে সেই সামগ্রিকতাও এই গানকে নির্মাণ করতে প্রেরণা জুগিয়েছে  বলে জানান শিল্পীরা। আরটিভি মিউজিকের ব্যানারে ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ গানটি উন্মুক্ত করা হয়।