মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা

কেরানি অরুণ থেকে মহানায়ক উত্তম

জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

আলাউদ্দীন মাজিদ

কেরানি অরুণ থেকে মহানায়ক উত্তম

আনন্দবাজারে একটি লাইন অবশ্য লেখা হয়েছিল সমালোচনায়, ‘উত্তমকুমার স্থানে স্থানে অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন।’ প্রবল ব্যর্থতার মধ্যে এই স্বীকৃতি তাকে সামান্য হলেও অক্সিজেন দিয়েছিল। এরপর ওই ১৯৫২ সালেই রিলিজ হলো ‘বসু পরিবার’। যার ওপর বাকি জীবনের শেষ দাঁওটা লাগিয়ে বাড়িতে বলেই দিয়েছিলেন উত্তম, আর নয়, এই ছবিও ব্যর্থ হলে ফিরে যাবেন কেরানি জীবনে। মেনে নেবেন, অভিনয়ে এসেছিলেন নেহাতই অল্প বয়সের আবেগ উন্মাদনায়। মেনে নেবেন, কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়া, দক্ষতা ছাড়া সমুদ্রে জাহাজ চালাতে নেমে পড়া ঘাট হয়েছে তার। অবশেষে ভাগ্যদেবী উত্তমের প্রতি বুঝি সুপ্রসন্ন হলেন, উনিশশো তিপ্পান্নতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ রিলিজের পর কী ঘটেছিল তা আজ ইতিহাস

 

‘এ কলির ভীমকে তোরা কোথায় পেলি? পায়ে পাথর বেঁধে না রাখলে ঝড়ে উড়ে যাবে, একেবারে নতুন আলু আমদানি হয়েছে গাঁ থেকে।’ লোকে টানা পাঁচ মাস অপমান সইতে পারে না, পুড়ে যায়। অরুণের পার হয়ে গেল পাঁচ বছর। পাঁচটা বসন্ত তিনি মাথা খুঁড়ে মরেছেন এই সেট ওই সেট, এই পরিচালক ওই প্রযোজকের উঠানে। একটা ছবিও বক্সে লাগাতে পারেননি পাঁচ বছরে, কেরানির চাকরি সামলে প্রবল পরিশ্রম করেও। চাকরি নিয়েছিলেন পোর্টের সামান্য কেরানির। মন বলল ‘বড়পর্দার নায়ক হব’। তারপর অরুন কুমার চাকরি বিসর্জন দিয়ে সিনোপাড়ায় চটির তলা ক্ষয় করতে শুরু করলেন। নিজের উপরে তার রাগ হয়, হাসি পায়, অভিমান হয়। পাঁচ সিকে পারিশ্রমিকে ভোলা আঢ্যের ‘মায়াডোর’ নামের একটি হিন্দি ছবিতে (টালিগঞ্জে তোলা) কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিবেশী গণেশদা ওরফে গণেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি গার্স্টিন প্লেসের বেতারবাড়ির নিয়মিত অভিনেতা, ভবানীপুরপাড়ার, ক্লাবের নটগুরু। তার সুপারিশে পোর্ট কমিশনারের চাকরিতে ফাঁকি দিয়ে অরুণ পৌঁছেছিলেন প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের মুখে তৎকালীন ভারতলক্ষ্মীর স্টুডিওতে (পরে যেখানে নবীনা সিনেমা হয়)। বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় মেট্রো সিনেমার প্রজেকশনিস্ট। এ ছাড়া চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংযোগ ছাড়াই এই স্বপ্ন দেখা যুবক কীসের ভরসায় জীবনকে নিয়ে এমন বাজি ধরেছিল, তা বোঝা দায়। চেহারা লগবগে, বাংলা উচ্চারণে জড়তা, মোটা ঠোঁট, ইংরেজি শিক্ষা দুর্বল, সামনে সিলেবাস বলতে হাতেগোনা প্রমথেশ, প্রদীপ কুমার, প্রভা দেবী, উদয়ের পথে। অভিজ্ঞতা পাড়ার ক্লাবের অ্যামেচার থিয়েটার, চলনসই রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার অভিজ্ঞতা। টিমটিম করা সাংস্কৃতিক পুঁজি বা আভিজাত্য নিয়ে সিনেমাকে সর্বস্ব দিয়ে আঁকড়ে ধরার এই মহাশ্চর্য আসলে গড়পড়তা হিসেবে ব্যাখ্যা করাই যায় না। লেখক-সাংবাদিক স্বপন মল্লিক তার ‘মহানায়ক রিভিজিটেড, দ্য ওয়ার্ল্ড অব উত্তম কুমার’ বইটিতে বলছেন, ‘উত্তম কুমারের গল্পে নাটক ও রহস্য, সংকল্প এবং ইচ্ছাশক্তি, পেশাদারি হতাশা এবং ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি সব রয়েছে। তার মতো মনের জোর ছাড়া, যা অন্য যে কাউকে ছিবড়ে করে দিতে পারত, নিয়তির একটা ভূমিকা থাকতে পারে, কিন্তু পেশার ক্ষেত্রে অসম্ভব শৃঙ্খলা তার ছিল, যা উত্তমের নিজের যাপিত জীবনের ঠিক বিপরীত।’ সেই ‘মায়াডোর’ ছবিতে প্রথমবার ক্যামেরার সামনে এক্সট্রার দায়িত্ব সামলালেও সেই ছবির রিল, ক্যানের বাইরে এলো না আর। কিন্তু ওই ব্যাখ্যাতীত নেশা আরও বেড়ে গেল অরুণের। স্বাধীনতার ঠিক পরের বছর, থিয়েটার-বায়োস্কোপে পোশাক জোগানের ব্যবসায়ী ধীরেন বাবুর দাক্ষিণ্যে আবার ক্যামেরার সামনে, এবার নীতিন বসুর পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের ‘দৃষ্টিদান’। সেবার সাতাশ টাকা পারিশ্রমিকের অর্ধেক গেল স্টুডিওয়ের ফড়েদের সিগারেট, চায়ের ‘কমিশন’-এ। ছবির নায়ক অসিতবরণের ছোটবেলার রোলে অভিনয় করেছিলেন অরুণ। ‘দৃষ্টিদান’ রিলিজ করেছিল বটে, কিন্তু সমালোচনায় কোথাও একটি বাক্যও বরাদ্দ হয়নি তার জন্য। প্রতিদিন কাগজের সমালোচনার পাতা ঘেঁটে মুখ ম্লান হয়ে যেত যুবকের। ছয় মাস পরে ‘কামনা’ ছবিতে। এবার জুটল নায়কের পার্ট, বিপরীতে ছবি রায়। ইন্দ্রপুরীতে শুটিং করছেন অরুণ, পাশের ফ্লোরে দাপিয়ে কাজ করছেন খ্যাতনামা অভিনেতা প্রদীপ কুমার, অ্যামেচার নাটকের সূত্রে যার সঙ্গে সামান্য চেনা ছিল অরুণের। তিনি কাজ দেখতে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলেন প্রদীপ কুমারের সঙ্গে। অরুণের তখন দশা, যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো কাজের সন্ধান। পুরনো সূত্রের কথা বলে আলাপ এগোনোর চেষ্টা করলেন। প্রদীপ কুমার বললেন, ‘ভাই তুমি এসো, সময় নষ্ট কর না। তোমায় চিনতে পারছি না।’ এই অপমানের ঢেউ একের পর এক ধাক্কা দিচ্ছে অরুণকে। সেই ঢেউ বা ফ্লপ ছবির কারও নাম ‘মর্যাদা’, ‘ওরে যাত্রী’, ‘সহযাত্রী’। কখনো ‘নষ্টনীড়’, ‘সঞ্জীবনী’। কখনো ফাইনাল টেক-এর মুহূর্তে প্রভা দেবী টিপ্পনী কাটছেন, ‘এ ছেলে অভিনয় করবে কী, এর তো এখন থেকেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।’ হাসির হররা পড়ে যাচ্ছে সেটে। আবার কখনো পিরিয়ড পিসের জবড়জং পোশাক পরে গোটা দিন অপেক্ষার পরেও ফাইনাল টেকের ডাক আসছে না। ছয় ঘণ্টা পর কেউ এসে বলে যাচ্ছে, ‘আপনাকে আর দরকার হচ্ছে না ভাই।’ ছবি এক সপ্তাহের মধ্যে হল থেকে উঠে যাচ্ছে। টাইটল কার্ডে নামও উল্লেখ করা হচ্ছে না। অর্থাৎ সব মিলিয়ে অরুণকে, ‘ইশারা নয় পাতাল সিঁড়ি দুই হাত নেড়ে ডাকছে।’ মরিয়া হয়ে উঠলেন এবার অরুণ। একের পর এক ফ্লপের পর প্রদীপ কুমারের ব্যস্ততার কারণে হাতের কাছে নায়ক না পেয়ে ১৯৫০ সালে ‘মর্যাদা’ ছবিতে কাজ দিতে রাজি হলেন পরিচালক সরোজ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু অদ্ভুত এক শর্তে। ওই অপয়া স্ক্রিন নেমটি বদলাতে হবে। নতুন নাম হবে অরূপ কুমার। অরুণ ‘নামে কী আসে যায়’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেটে। কিন্তু ছবির আবারও সুপার ফ্লপ হওয়া আটকাতে পারলেন না অরূপ কুমারও। ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ তকমা তখনই তৈরি হলো স্টুডিওতে। তবে এর মধ্যেও সামান্য রুপোলি রেখা ছিল বলেই ‘মর্যাদা’ ফ্লপের পরেও আরও দুই বছর স্টুডিওপাড়ায় টানতে পেরেছিলেন উত্তম। সাউথ সিঁথি আর বরানগরের ক্রসিংয়ের কাছে ছিল তখনকার ডাকসাইটে এম পি স্টুডিও। পাহাড়ী সান্যাল এবং আরও কিছু ব্যক্তির সুপারিশে সেখানে মাসিক চারশো টাকা বেতনে স্টাফ আর্টিস্টের চাকরি পেয়ে ডুবন্ত সংসারে হাল ধরেছিলেন সে দিন অরুণ। সেখানে তখন ‘সহযাত্রী’ ছবির কাজও শুরু হবে নতুন পরিচালক গোষ্ঠী ‘অগ্রদূত’-এর পরিচালনায়। ‘কামনা’য় (১৯৪৯) তার নাম ছিল উত্তম চ্যাটার্জি। সব ফেলে নতুন নাম নিলেন অরুণ। উত্তম কুমার। দীর্ঘদিন খরার পর অলক্ষ্যে নিয়তি নির্ঘাত মুচকি হেসেছিল সে দিন। তবে চলল না ‘সহযাত্রী’ এবং ওই ১৯৫১ সালে তৈরি আরও একটি ছবি ‘সঞ্জীবনী’ও। দ্বিতীয় এই ছবিটিতে বিপরীতে ছিলেন সন্ধ্যারাণী। ছবি আবারও ফ্লপ। আনন্দবাজারে একটি লাইন অবশ্য লেখা হয়েছিল সমালোচনায়, ‘উত্তম কুমার স্থানে স্থানে অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন।’ প্রবল ব্যর্থতার মধ্যে এই স্বীকৃতি তাকে সামান্য হলেও অক্সিজেন দিয়েছিল। এর পর ওই ১৯৫২ সালেই রিলিজ  হলো ‘বসু পরিবার’। যার উপর বাকি জীবনের শেষ দাঁওটা লাগিয়ে বাড়িতে বলেই দিয়েছিলেন উত্তম, আর নয়, এই ছবিও ব্যর্থ হলে ফিরে যাবেন কেরানি জীবনে। মেনে নেবেন, অভিনয়ে এসেছিলেন নেহাতই অল্প বয়সের আবেগ উন্মাদনায়। মেনে নেবেন, কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়া, দক্ষতা ছাড়া সমুদ্রে জাহাজ চালাতে নেমে পড়া ঘাট হয়েছে তার। অবশেষে ভাগ্যদেবী উত্তমের প্রতি বুঝি সুপ্রসন্ন হলেন, উনিশশো তিপ্পান্নতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ রিলিজের পর কী ঘটেছিল তা আজ ইতিহাস। বাংলা সিনেমা শুধু নয়, সামগ্রিক বঙ্গজাতির অবশ্য পাঠ্য সিলেবাসের মধ্যে তা ঢুকে গিয়েছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গও নয়, গোটা বিশ্বের বাঙালির সামাজিক-সাংস্কৃতিক, এমনকি ব্যক্তি পরিসরেও এক চিরস্থায়ী মুদ্রা কীভাবে হয়ে উঠলেন উত্তম কুমার, সেই বৃত্তান্তে নিত্যনতুন আলো পড়ছে আজও। তার মৃত্যুর ৪৪ বছর কেটে যাওয়ার পরেও যে আলো, উত্তম কুমারের হাসির মতোই এক সঙ্গে সম্মোহক এবং নির্মল। আজ এই মহানায়কের জন্মদিনে বিশ্বের বাঙালি পরিবারগুলো সমম্বরে গেয়ে উঠছে- ‘শুভ জন্মদিন আজ তোমার হে মহানায়ক তুমি অমর রবে অনন্তকাল।’

সর্বশেষ খবর