শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৪ ০০:০০ টা

ছবির খবর নেই, নেতৃত্ব নিয়েই ব্যস্ত সবাই

আলাউদ্দীন মাজিদ

ছবির খবর নেই, নেতৃত্ব নিয়েই ব্যস্ত সবাই

‘চলচ্চিত্র জগতের দীর্ঘদিনের খরার কথা বাদই দিলাম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে গত জুলাই মাস থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র দুটি ছবি মুক্তি পেলেও সফলতার দেখা পায়নি সেসব। সিংহভাগ সিনেমা হল বন্ধ, চলচ্চিত্রের নির্মাণকাজও চলছে না। এতে সিনেমা হল মালিকরা পড়েছেন চরম বিপাকে। অনেক ছবি আছে কিন্তু মুক্তি দিচ্ছেন না প্রযোজকরা। চলচ্চিত্র প্রযোজক কামাল কিবরিয়া লিপু বলেন, প্রযোজকরা ছবি মুক্তি দেবে ঠিকই কিন্তু তার আগে প্রদর্শকদের ছবির অর্থ ফেরতের গ্যারান্টি দিতে হবে। প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস বলেন, প্রযোজকদের কাছে বর্তমানে মুক্তি দেওয়ার মতো যেসব ছবি রয়েছে তার সবই যে মানসম্মত এবং ব্যবসা করবে সেই গ্যারান্টি কি তারা দিতে পারবে? চলচ্চিত্রবোদ্ধারা সমিতিগুলোর এমন কাদা ছোড়াছুড়িতে চরম নাখোশ। তারা বলছেন, দেশীয় শিল্পের অস্তিত্ব নিয়ে চলচ্চিত্রের মানুষের কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা সবাই এখন ব্যস্ত নেতা হওয়া আর দল গঠন নিয়ে। চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কথায়- ছবি নির্মাণ বা মুক্তি চলচ্চিত্রকারদের কাছে এখন মুখ্য বিষয় নয়, তাদের প্রধান চিন্তা হলো কীভাবে নেতা হওয়া যায়, নেতৃত্বে গিয়ে কতটা ফায়দা হাসিল করা যায়। অতীতে একটি সমিতির এক কর্মকর্তা সমিতির সাইনবোর্ড ব্যবহার করে নানা আয়োজনের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বড় অঙ্কের চাঁদা তুলে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন বলেও চলচ্চিত্রাঙ্গনে প্রচার আছে। তাদের কাছে বছরে কয়টি ছবি মুক্তি পেল সেটি প্রধান বিষয় নয়, নতুন নতুন দল আর সমিতি তৈরিতেই তারা সদা ব্যস্ত থাকে। এভাবে এত দিন ধরে প্রায় ১৯টি সংগঠনের জন্ম দিয়ে ফেলেছেন তারা। এখন আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন দল গঠনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এরা। ইতোমধ্যে গঠন করে ফেলেছে ‘চলচ্চিত্র উন্নয়ন ফোরাম’ এবং ‘বৈষম্যবিরোধী চলচ্চিত্র স্বার্থ সংরক্ষণ কমিটি’ নামে আরও দুটি সংগঠন। অনেক দিন ধরে পুরো এফডিসি ছিল ফাঁকা। কিন্তু গত বুধবার থেকে পাল্টে গেছে চিত্র। এফডিসিতে এখন নতুন দল গঠন ও এর কার্যক্রম নিয়ে মুখর চলচ্চিত্রের কিছু মানুষ। এফডিসিতে চলচ্চিত্রাঙ্গনের ১৯টি সংগঠন থাকার পরও কেন চলচ্চিত্র উন্নয়ন ফোরাম গঠনের দরকার পড়ল? সংস্কারের কথা বলে পক্ষ-বিপক্ষ কেন তৈরি হচ্ছে? এ প্রসঙ্গে সাবেক প্রযোজক সমিতির নেতা সামসুল আলম বলেন, আমাদের সামনে উজ্জ্বল ভাই, মাসুদ পারভেজ ভাই, হেলাল খান, লতিফুর রহমান বাচ্চু রয়েছেন। তারাই আমাদের গুরু। তারা যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই হবে। তবে আমি বলব যেহেতু সবার উদ্দেশ্য এক, সেখানে আমরা অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে চাই, আমাদের দ্বিমত নেই। আমাদের মতাদর্শ আলাদা নয়। এদিকে চলচ্চিত্রের স্বার্থে সবাইকে নিয়ে ৫ আগস্টের পরে গঠন করা হয় অরাজনৈতিক আরেকটি সংগঠন। এর নাম ‘বৈষম্যবিরোধী চলচ্চিত্র স্বার্থ সংরক্ষণ কমিটি’। এর কমিটিও ঘোষণা করা হয়েছে। সেই কমিটির প্রধান পরিচালক বদিউল আলম খোকন। তাদের সঙ্গে রয়েছেন শিবা শানুসহ অনেকে। বদিউল আলম বলেন, সবাই যার যার জায়গা থেকে সিনেমার জন্য কথা বললে, কাজ করলে তাতে তাদের আপত্তি নেই। তারা দলাদলি, পাল্টাপাল্টি সংগঠন চান না। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ আর প্রদর্শনের জন্য দল ও সমিতির প্রয়োজন কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ পৃথিবীর কোনো দেশে এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মতো এত বড় একটি রাষ্ট্রেও চলচ্চিত্র সমিতির কোনো অস্তিত্ব নেই। ভারতজুড়ে চলচ্চিত্রের স্বার্থ রক্ষায় রয়েছে একটি মাত্র সংগঠন। যার নাম হলো ‘ইন্ডিয়ান মোশান পিকচার অ্যাসোসিয়েশন’ (ইমপা)। আর আমাদের মতো ছোট একটি দেশে চলচ্চিত্র আর সিনেমা হলের পরিমাণ কম হলেও চলচ্চিত্র সমিতি ও দলের কোনো অভাব নেই। এফডিসিতে প্রদর্শক সমিতির অফিস ছাড়া অন্য সব সমিতির অফিস রয়েছে। এগুলোর ভারে সংস্থাটি এখন জর্জরিত। সেখানে চলচ্চিত্রকাররা যান এখন রাজনৈতিক কার্যকলাপ, গালগল্প, এক সমিতি অন্য সমিতির বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি, পিকনিক, ইফতার পার্টিসহ নানা আয়োজনের নামে চাঁদা উত্তোলনের মতো স্বার্থ হাসিলের কাজে জড়িত হতে। এফডিসিতে এখন কোনো চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ‘কী কাজ করছেন’ এমন প্রশ্ন করা হলে জবাব পাওয়া যায়- ‘নারে ভাই, হাতে কোনো কাজ নেই, এখানে এসেছিলাম অমুক সমিতিতে যাওয়ার জন্য, সেখানে বসে একটু গল্প করব, সময় কাটাব এই আর কি?’

এ কারণে এফডিসিকে এখন চলচ্চিত্রপাড়ার পরিবর্তে সমিতিপাড়া নামেই আখ্যায়িত করছেন অনেকে। এখানে রীতিমতো মিছিল-মিটিং হয়ে থাকে। চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের প্রশ্ন- ‘এফডিসি হলো কেপিআইভুক্ত এলাকা। কেপিআইভুক্ত এলাকায় কী করে সমিতি থাকতে পারে এবং দলীয় কার্যক্রম চলে, কীভাবে মিছিল-মিটিং হয়। সরকার এক্ষেত্রে নীরব কেন? সিনিয়র চলচ্চিত্রকার বলছেন, ‘এফডিসিতে কাজের চেয়ে সংগঠন করা আর একে অপরের ওপর রেষারেষি করা নিয়েই ব্যস্ত। বলা যায়, কর্মশূন্য এফডিসিতে সবাই এখন ব্যস্ত সমিতি আর দল নিয়ে। স্বাধীনতা লাভের পর এখানে কাজের পরিধি যত বেশি ছিল সমিতি আর দল তত কম ছিল। এখন হয়েছে উল্টো, ছবি কম সমিতি আর দল বেশি।’

সর্বশেষ খবর