পৃথিবীতে রয়েছে দুই হাজারের বেশি প্রজাতির মাছি, যাদের মধ্যে অধিকাংশই বিরক্তিকর ও রোগজীবাণুবাহী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এই সাধারণ ধারণাকে পাল্টে দিচ্ছে এক বিশেষ প্রজাতির মাছি। ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই নামের এই মাছিকে বলা হয় প্রকৃতি ও কৃষকের বন্ধু; টেকসই কৃষি ও প্রাণিখাদ্যের ভবিষ্যৎ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি কম খরচে এই মাছি থেকে তৈরি হয় উন্নতমানের প্রাণিখাদ্য ও জৈব সার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু মাছির খামার গড়ে উঠেছে। তবে এটা নিয়ে সরকারের কোনো নীতিমালা ও প্রচারণা না থাকায় খুব কার্বনশূন্য প্রাকৃতিক কৃষিতে বিপ্লব ঘটানোর এই অপার সম্ভাবনা আলোর মুখ দেখছে না।
তথ্য বলছে, ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই মূলত একটি অপ্রাণঘাতী মাছি; যা মানুষের খাবার বা স্বাস্থ্যহানি করে না। বরং এর লার্ভা পরিবেশবান্ধব উপায়ে বর্জ্য ভক্ষণ করে এবং দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এই লার্ভা থেকে উৎপন্ন হয় উচ্চ আমিষসমৃদ্ধ প্রাণিখাদ্য, যা মাছ, হাঁস-মুরগির খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একটি পূর্ণবয়স্ক লার্ভা ১৪-১৮ দিন বয়সে প্রায় ৪০-৪৫% আমিষ ও ৩০% লিপিড (চর্বি) ধারণ করে, যা সস্তা, সহজলভ্য এবং অত্যন্ত পুষ্টিকর প্রাণিখাদ্য বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, নেদারল্যান্ডস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কেনিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অনেক দেশেই এখন ব্লাক সোলজার ফ্লাই চাষ বিলিয়ন ডলারের শিল্পে রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, রাজশাহী, ভোলা, গাইবান্ধাসহ কিছু এলাকায় ছোট পরিসরে মাছির খামার গড়ে উঠেছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকারি সহযোগিতা থাকলে তারা বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে প্রস্তুত।
খামারিদের মতে, মাছির লার্ভা দিয়ে তৈরি খাদ্য খেলে মাছ ও হাস-মুরগির বৃদ্ধি দ্রুত হয়, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়। লার্ভা ব্যবহারে খামারে উৎপাদন খরচ ২০-২৫% পর্যন্ত কমে। অল্প জায়গাতেই চাষ করা যায় এই মাছি। ঘরে ঘরে এই মাছি চাষ বাড়লে কমে যাবে পোলট্রি ও মাছের খাদ্য নিয়ে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য।
অনেকে ইঞ্জিনিয়ারিং বা করপোরেট পেশা ছেড়েও মাছি চাষে ঝুঁকছেন। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রশিক্ষণের সুযোগ না থাকায় ইউটিউব ভিডিও ও ইন্টারনেটই এ ব্যাপারে তাদের মূল সহায়ক। রাজধানীর শাহবাগ এলাকার তরুণ উদ্যোক্তা ইমরান কবীর কয়েক বছর আগে ছাদের ওপরে শুরু করেন ব্লাক সোলজার ফ্লাই চাষ। তিনি রীতিমতো মাছি নিয়ে গবেষণা করেন। তিনটা পর্যায় নিয়ে ল্যাবে পরীক্ষা করান। তাতে দেখা যায়, বাজারে প্রচলিত পোলট্রি ও মাছের খাদ্যে আমিষের পরিমাণ যেখানে থাকে ১৬-৩২%, সেখানে মাছিতে সর্বোচ্চ আমিষ পাওয়া গেছে ৬৩%, হার্ভেস্টিং সময়ে আমিষ ৪৯.৩৬% ও সবচেয়ে কম আমিষ পাওয়া গেছে ৩৭.৫২%।
দীর্ঘদিনের গবেষণায় তিনি দেখেছেন, ব্লাক সোলজার ফ্লাইয়ের জীবনচক্র ৪৫ দিনের। এর কোনো কিছুই ফেলনা নয়। ৩০০ গ্রাম মাছি উৎপাদনে ৭০০ গ্রাম জৈব সার পাওয়া যায়। মাছি বের হওয়ার পর লার্ভার খোলস জৈব প্লাস্টিক হিসেবে ফার্মাসিউটিক্যাল ও কসমেটিক্স শিল্পে ব্যবহার হয়। মৃত মাছি থেকে দুটি উপজাত বের হয়। তাতে আমিষের পরিমাণ থাকে অনেক বেশি। মাছি চাষে এক স্কয়ার ফিট জায়গা থেকে বছরে ২ টন বর্জ্য রূপান্তর করে ৮৫০ থেকে ১০০০ কেজি এনপিকে সার ও ৩০০ থেকে ৪০০ কেজি প্রাণিখাদ্য পাওয়া যায়।
ভোলার মিজানুর রহমান ও গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের আল-মামুন শেখও মাছির খামার গড়ে তুলেছেন। মিজানুর রহমানের লক্ষ্য প্রতিদিন এক টন প্রাণিখাদ্য উৎপাদন করা। ৪০ টাকা দরে যার বাজারমূল্য ৪০ হাজার টাকা।
বর্তমানে মিজানুরের খামারে উৎপাদন ১০০-১৫০ কেজি হলেও কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত এক ডজন মানুষের। মিজানুর রহমান বলেন, মাছির লার্ভায় আমিষ অনেক বেশি। এই খাবার মুরগি ও মাছ খুবই আগ্রহ নিয়ে খায়। রোগবালাই কম হয়। বৃদ্ধিও দ্রুত হয়। আবার বাজারের ফিডের চেয়ে দাম কম। লার্ভাকে পচনশীল খাবার খাইয়ে বড় করা হয়। এক কেজি লার্ভা উৎপাদন করলে চার কেজি জৈব সার তৈরি হয়।
কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, মাছি চাষ বাংলাদেশে উদীয়মান একটা খাত। এই প্রযুক্তি গ্রামপর্যায়ে বিস্তার পেলে তা কৃষি ও পরিবেশের আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াবে। এটি বেকারত্ব হ্রাস এবং পরিবেশ সংরক্ষণেরও বড় হাতিয়ার হতে পারে।