এই টার্মে প্রথমবারের মত আমার লেভেল ১, টার্ম ১ এর থিওরি ক্লাস নেওয়ার সৌভাগ্য হয়। অন্য লেভেল টার্মের থিওরি ক্লাস নেওয়ার পর ১-১ এর ক্লাস নিয়ে একটা পার্থক্য পরিষ্কারভাবে আমার চোখে পড়ল। তা হল ১-১ এর প্রতিটা ছাত্র-ছাত্রী ক্লাসে খুবই মনোযোগী। ক্লাসে এদের উপস্থিতি মোটামুটি ১০০% ছিল সবসময়ই, এবং ১ ঘণ্টার ক্লাসের পুরোটাই ফার্স্ট বেঞ্চার থেকে শুরু করে লাস্ট বেঞ্চার পর্যন্ত প্রত্যেকেই খুব মন দিয়ে শুনতো। যেসব জায়গায় প্রশ্ন আশা করতাম, তারা প্রশ্ন করত- একজন নির্দিষ্ট মানুষই যে সব সময় প্রশ্ন করত তা নয় বরং ফার্স্ট বেঞ্চার থেকে শুরু করে লাস্ট বেঞ্চার সবাই-ই ক্লাসে ইন্টার্যাক্টিভ ছিল। সিটিগুলোর সময়ও তারা পারুক বা না পারুক, পড়াশোনা করে এসেছে এবং চেষ্টা করেছে এতটুক বোঝা যেত। অথচ এই সেইম ব্যাচটার ক্লাসই আমি যদি আবার সামনের বছর তারা ২-১ এ উঠলে নিই, পূর্ব অভিজ্ঞতা হতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে তারা ক্লাসে কতটুকু ইন্টার্যাক্টিভ থাকবে, সিটিগুলোতে কতটুকু প্রিপারেশান নিয়ে আসবে। বুয়েটে এক টার্ম যেতে না যেতেই কেমন জানি এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা আর হতাশা ভর করে স্টুডেন্টদের মাঝে। আগে মনে হত বুয়েটে চান্স পাওয়ার আনন্দে খেই হারিয়ে হয়তো তারা পি এল এ ঠিকমত পড়ালেখা করে না, যার জন্য ১-১ এর রেজাল্ট খারাপ হয়, সারাজীবন নিজেকে ভালো স্টুডেন্ট জেনে আসা ছেলেটা এই খারাপ রেজাল্ট মেনে নিতে পারে না। ফলাফলে হতাশায় পড়ে। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে এক সময় পড়ালেখাটা পুরোপুরিই ছেড়ে দেয়, শুরু হয় হতাশার দুষ্টচক্র।
এখন বুঝতে পারছি আমার চিন্তাভাবনায় বড় রকমের একটা লুপহোল ছিল। আবরার হত্যাকাণ্ডের পর হলের অত্যাচারের অনেক ঘটনা এই কয়দিনে প্রকাশ পেয়েছে- একেকটা ঘটনা পড়ে আমি কেঁদে ফেলেছি। তারাও আবরারের মতই পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে, এরকম মার খাওয়ার পরেও তারা যে বেঁচে গেছে এটাই আশ্চর্য। কিন্তু এভাবে মার খেয়ে বেঁচে থাকতে হলে, সেই বেঁচে থাকাকে কি আসলেই বেঁচে থাকা বলে? ইংরেজিতে বললে, তারা হয়তো "survive" করে গিয়েছিল কিন্ত এরপর আর কখনোই তারা তথাকথিত land of "living" এ "live" করতে পারেনি। আমি খালি ভাবছি, ওইদিন যদি আবরার 'survive' করে যেত তাহলে কী হত? দশদিন পরে অনুষ্ঠিতব্য টার্ম ফাইনালে সে আদৌ বসতে পারতো কি? বসতে পারলেও পরীক্ষা প্রস্তুতি সে কিভাবে নিত? সে কি এরপর আর হলে থাকতে পারতো? থাকলেও কি সেখানে পড়াশোনা কন্টিনিউ করার মত শারীরিক বা মানসিক সুস্থতা তার থাকতো? থাকার তো কোনো কারণ দেখি না আমি। যথারীতি তার রেজাল্ট ভয়াবহ খারাপ হত। আজকে মারা গিয়ে জনতার কাছে সে মেধাবী হিসেবে সম্মান পাচ্ছে, আর বেঁচে থাকলে তার কপালে লো সিজিধারী/ ল্যাগার তকমা জুটে যেত। সারাজীবন যে ছেলেটা টপার ছিল, নিজের একাডেমিক এই অবনতি সে সহজে মেনে নিতে পারতো না- নিমজ্জিত হত ডিপ্রেশনে। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত মানুষ অন্যদের সাথে সামাজিক সম্পর্কও সহজে টিকিয়ে রাখতে পারে না। ফলাফলে তার বন্ধু-বান্ধব কমে আসতো। আবার রেজাল্ট খারাপ হলে অনেক শিক্ষকই বৈষম্যমূলক আচরণ করেন। শিক্ষকরাও স্নেহ করেন না, বন্ধুও তেমন একটা নেই- এই অবস্থায় ক্লাসে যাওয়ার জন্য উৎসাহটাও সে হারিয়ে ফেলতো। যেহেতু ক্লাস ঠিকমত করে না, রেজাল্ট দিনদিন আরো খারাপ হত, ডিপ্রেশন বাড়তো চক্রবৃদ্ধিহারে। এ যেন ডিপ্রেশনের দুষ্টচক্র পুরোপুরি। ওইদিকে সম্মানিত বড় ভাইদের শারীরিক অত্যাচারতো আছেই। সবমিলে সে পরিণত হত একটা জীবন্ত লাশে। এরকম শত শত জীবন্ত লাশ আজ বুয়েটের প্রতি ব্যাচে ব্যাচে।
যেখানে বুয়েটের বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী হলে থাকে সেখানে এই হলেই আমরা পড়াশোনার কোনো পরিবেশ দিতে পারছি না। ঢাকায় থাকা অল্প সংখ্যক স্টুডেন্ট যখন পি এলে বাবা মায়ের আদরে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে, রাত জেগে পড়লে মা দুধ বানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, তখন হলে থাকা ছেলেগুলো খুব কাছেই "পিতামাতাতুল্য" শিক্ষকদের কোয়ার্টার থাকার পরেও চুপচাপ পশুর মত মার খাচ্ছে। শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ জানানোর মত সাহসটা পর্যন্ত তাদের নেই। শিক্ষকদের জানালে কোনো লাভ হবে- এই আশা তো তারা করেই না, উল্টো জানাতে গিয়ে পরে বিপদ আরো বাড়ে কিনা এই ভয়েই তারা শেষ- কী ভয়াবহ অসহায়তা!ভাবছি, এই যে দেশ-বিদেশে বুয়েটের এত সুনাম তার কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য, প্রতিবছরই MIT, Stanford, UC Berkeley ইত্যাদিতে বুয়েটের স্টুডেন্টরা পোস্ট গ্রেডে চান্স পায় বা Google, Intel ইত্যাদিতে জব অফার পায়- তার কতটুকু ক্রেডিট আসলে বুয়েটের নিজের? বুয়েট তো শুরুতেই প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সারাদেশের ১০০০ জন ক্রিম ছাত্র-ছাত্রী আলাদা করে ফেলে। বুয়েটকে তো আসলে তখনই ক্রেডিট দেওয়া উচিত যদি এই ১০০০ জন ক্রিম ছাত্র-ছাত্রীর প্রত্যেককে সে দক্ষ গ্র্যাজুয়েট বানাতে পারে, কারণ ওই ১০০০ জন স্টুডেন্টের প্রত্যেকেরই যথেষ্ট যোগ্যতা আছে। অথচ বাস্তব চিত্র হচ্ছে ১০০০ জন ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে বড়জোর ১০০ জনই হয়তো দিনশেষে বিভিন্ন বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পায়, বড় বড় রিসার্চ করে, সারা পৃথিবীর মানুষ তখন বুয়েটকে চেনে। আর এই ১০০ জনের দোহাই দিয়ে আমরা দম্ভে গৌরবে নাচানাচি করি। বাকি ৯০০ জন 'পটেনশিয়াল' স্টুডেন্টের যোগ্যতাকে আমরা যে গলাটিপে হত্যা করেছি, তা যেন আমরা দেখেও না দেখার ভান করতে চাই। অথচ ১০০০ জন মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর দায়িত্ব নিয়ে মাত্র ১০০ জনের মেধাকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি, তার মানে আমাদের 'এফিশিয়েন্সি' মাত্র ১০%- এটা কি আমাদের সিস্টেমের বিশাল ব্যর্থতা নয়? উল্লেখ্য যে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে ওই ১০০ জনের মাঝে ৯০ জনের বাসাই ঢাকাতে ছিল, তাই তারা সুস্থ পরিবেশে পড়াশোনা করতে পেরেছিল। তারা যদি বুয়েটে নিয়মিত ক্লাস নাও করতো, তবু তারা দিনশেষে ভালোই করত। আফটার অল, সব টপিকের চমৎকার সব লেকচার আজকাল ইউটিউবেই এভেইলেবল।
আরেকটা ব্যাপার। হলে যারা নির্যাতনের শিকার হয়, তারাই কি শুধু আমাদের এই ত্রুটিপূর্ণ সিস্টেমের ভিকটিম? আমিতো মনে করি, যারা নির্যাতন করে তারাও আমাদের এই সিস্টেমেরই ভিক্টিম। আজকে যদি আমরা অসুস্থ লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতিকে শক্ত হাতে প্রতিহত করতাম, র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতাম, হলের ছাত্রদেরকে বাবা মায়ের মতই শাসনে রাখতাম তাহলে ওই ছেলেগুলোও হয়তো বিপথগামী হত না। যখন তারা বাবা-মায়ের কাছে ছিল তখন তো তারাও লক্ষ্মী আর পড়ুয়া ছাত্রই ছিল, তারাও নিজ নিজ স্কুল কলেজে টপার ছিল। বাবা মায়ের লক্ষ্মী সন্তানদের অসুস্থ পরিবেশে এনে আমরা নিজ হাতে তাদের খুনি বানিয়েছি। আমরা আসলে আবরারের খুনিদের চেয়েও জঘন্য অপরাধী। আজ যদি আমরা প্রায়শ্চিত্ত না করি তাহলে দয়াময় খোদাও আমাদের কোনোদিন মাফ করবেন না। আজ সময় এসেছে এই ভাঙাচোরা সিস্টেমটাকে ঠিক করে ঢেলে সাজানোর। সিস্টেম ঠিক না হওয়া পর্যন্ত অন্তঃসারশূন্য একাডেমিক কার্যক্রমের আসলেই কোনো মূল্য নাই।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
লেখিকা: প্রভাষক, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগ, বুয়েট
বিডি প্রতিদিন/মাহবুব