২৭ অক্টোবর, ২০১৯ ১১:০৫

ঘটনা শুনে মুহূর্তেই চোখ মুখ পাংশু হয়ে গেল

কাজী ওয়াজেদ

ঘটনা শুনে মুহূর্তেই চোখ মুখ পাংশু হয়ে গেল

কাজী ওয়াজেদ

চাকরীর ব্যস্ততার কারনে সন্তানদের পড়াশুনায় কখনো ভূমিকা রাখতে না পারার আক্ষেপ সবসময়ই ছিল আমার। তাই গতকাল শুক্রবার ছিল বিধায় ভাবলাম, মেয়েটার বিইউপি’র পরীক্ষা কেন্দ্রে আমি নিজেই নিয়ে যাবো আজ। বেলা সোয়া তিনটায় একজন দায়িত্বশীল বাবার মত অভিনব কৃত্রিম হাসি দিয়ে মেয়েটাকে পরীক্ষার হলে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছি। ভাবছি কোনরকম সাড়ে চারটা বাজলেই রক্ষে।

এমন সময় আদমজী ক্যান্ট: কলেজের সামনে রংপুরে কর্মরত প্রিয় ব্যাচমেট হুমায়ুনের সাথে দেখা। সেও রংপুর থেকে তার মেয়েকে নিয়ে এসেছে পরীক্ষা দিতে। ভাবলাম এতদিন পর দেখা, নিশ্চয় একটা ঘন্টা সুন্দর গল্প করে কাটানো যাবে দোস্তের সাথে।

দুই দোস্ত সুখ দুঃখের গল্প শুরুর কিছুক্ষন পরেই হঠাৎ থানা থেকে ফোন ! স্যার, নর্থ ব্রুক হল রোডের চার তলার সিঁড়িতে ছুরিকাহত অবস্থায় যুবকের মৃতদেহ পড়ে আছে। ঘটনা শুনে মুহূর্তেই চোখ মুখ পাংশু হয়ে গেল!! দোস্তও পুলিশের লোক বিধায় বিবর্ন ফ্যাকাশে চেহারা দেখে ওর বুঝতে বাকি রইল না যে থানা এলাকায় কত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।

কি যে করি ভেবে পাচ্ছি না। এখনো আধা ঘন্টা বাকি পরীক্ষার। মেয়েটা বের হয়েই আমাকে খুঁজবে, পরিচিত আর কেউ নেই যে ওকে এত দূরের বাসায় পৌঁছে দিবে। ওর কাছে কোন টাকা পয়সাও নেই। কিন্তু খুব খুশি মনে ও আজ পরীক্ষার হলে ঢুকেছে। মনে মনে হয়ত ভেবেছে আমার বীর পুরুষ বাবা আজ আছে আমার সাথে !!

এদিকে বারবার ফোন করছি অফিসারদের। ফোনে গাইড করলেও একটা ভয় কাজ করছে। ওরা না আবার কোন ভুল করে বসে ! স্পর্শকাতর একটা হত্যার ঘটনা। শুরু থেকেই নিখুঁতভাবে প্রতিটা কাজ করতে হবে।

সবচেয়ে বেশি ভয় হচ্ছে ঊর্ধত্বন অফিসারদের কথা ভেবে। আমার আগেই যদি ওনারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান তো ভৎসনা শুনতে হতে পারে। সব ঘটনা ফোনেই জানানো হল স্যারদের। ছুটির দিনে থাকা পারিবারিক কাজ ফেলে এবং স্ত্রী-সন্তানকে নূন্যতম সময় দেওয়া বাদ দিয়ে স্যারেরাও রওনা দিলেন ঘটনাস্থলে। ওনাদের মূল্যবান পরামর্শ মোতাবেক সকল কাজ শুরু করতে বলা হল ঘটনাস্থলে থাকা অফিসারদের।

প্রতিটা মূহূর্ত কাটছে উৎকন্ঠায় ! আর কতক্ষন লাগবে পরীক্ষা শেষ হতে ? একবার মনে হল মেয়ের দরকার নেই বাবা ! চাকরীটা আমার খুব দরকার, বরং সেটাই আগে বাঁচাই ! দ্রুত চলে যাই থানা এলাকায়। বাবাকে না পেয়ে মনে কষ্ট পেলেও ও হয়ত একসময় পৌঁছে যাবে বাসায়।

ভয়ে ভয়ে এক স্যারকে ফোনে বললাম ক্যান্ট: এলাকায় মেয়ের পরীক্ষার হলে থাকার কথা। বললাম খুব শীঘ্রই চলে আসার কথাও। স্যার বিরক্ত না হলেও নিজের মধ্যে অশান্তি থামলো না মোটেও।

মানসিক অস্বস্তি নিয়ে মসজিদে ঢুকে আসরের চার রাকাত নামাজ একা একা যে কিভাবে এত তাড়াতাড়ি শেষ হল তা আল্লাহপাকই ভাল জানেন। একবার কল্পনায় মৃতদেহের ছবি, আরেকবার মেয়ের পরীক্ষা শেষের মুখচ্ছবি ভাসছে চোখের সামনে বারবার।

যাবতীয় উৎকন্ঠা নিয়ে একসময় পৌঁছলাম ঘটনাস্থলে। বিলম্বে পৌঁছানোর কারনে কোনরূপ ভৎসনা না শোনায় স্যারদের মহানুভবতায় মুগ্ধ হলাম। খুব দ্রুতই সবার সম্মিলিত চেষ্টায় শেষ হল প্রাথমিক কাজ।

সবকাজ শেষে রাত তখন ২ টা। সারাদিনের হিসেব মিলাতে যেয়ে ভাবলাম, অন্তত একটা দিন, একটা মূহূর্তও আমাদের সন্তানদের জন্য বের করতে পারিনা! এমন চাকরীই তো বড় দরকার ছিল।


(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক : ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সূত্রাপুর থানা, ডিএমপি।


বিডি-প্রতিদিন/ সিফাত আব্দুল্লাহ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর