শিরোনাম
১৯ মার্চ, ২০২০ ২২:০২

মৃত্যুর বাস্তবতা, জন্মের আনন্দকেও ম্লান করে দেয়

চৌধুরী জহিরুল ইসলাম

মৃত্যুর বাস্তবতা, জন্মের আনন্দকেও ম্লান করে দেয়

চৌধুরী জহিরুল ইসলাম

মৃত্যুর বাস্তবতা যে কোনো মানুষের জীবনে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। যা জন্মের আনন্দকেও ম্লান করে দেয়! একটা ব্যস্ততম শহর কতটা মৃত্যুপুরিতে পরিণত হতে পারে, তা উপলব্ধি করতে পারতাম না, যদি না গতকাল পুকেপ্সি শহর প্রদক্ষিণে বের না হতাম!

একটা ঝরঝরে রৌদ্রকরোজ্জল সকাল ছিল গতকাল। গত কয়েক দিন ঘরের ভেতর প্রায় বন্দী। প্রয়োজন ছাড়া বেরোচ্ছিলাম না। কিন্তু আজ বের হতেই হবে। গাড়িটিকে শহরের পূর্বপ্রান্তে পার্ক করে ডান পাশের পশ্চিম দিক ধরে হাঁটা দিলাম।

বসন্ত দ্বারপ্রান্তে। কোথাও কোথাও হলুদ ডেফোডিল ফুটে গেছে। ১৪৪ বছরের মধ্যে এবারই বসন্ত এত আগে দেখা গেল। তথাপি সূর্যটা এখনো দক্ষিণে হেলানো। তাই মেইন স্ট্রীট-এর উত্তরপ্রান্তের ফুটপাথ ধরে হাটছি, যাতে রোদের পুরোটা গায়ে মাখা যায়! আমার উদ্দেশ্য শহরের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে হেটে যাওয়া। যাতে জনজীবনের পুরোটা দেখা যায়।

বলে রাখা ভালো আমেরিকার প্রতিটি ছোট শহরে “মেইন স্ট্রীট” নামে একটি সড়ক আছে। যে সড়কের ফুটপাথ ধরে হাটলে নাগরিকদের সাক্ষাত পাওয়া যায়। স্থানীয় নাগরিকরা যে সড়কের ফুটপাথে রাখা স্টীলের বেঞ্চে বসে রোদ পোহায়, আড্ডা দেয়, কিংবা রাজনৈতিক সামাজিক বিষয় নিয়ে আলাপ করে। কেউবা গাড়ি পার্ক করে দরোজা খুলে উচ্চস্বরে গান ছেড়ে দেয়।

গতকাল হাঁটার সময় এসবের কিছুই নজরে এলো না। রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। যে কয়জন চোখে পড়ল, তারা সমাজের একেবারে প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠির। জীবনের মায়া তাদের স্বাভাবিকভাবে কম!

তিন কিলোমিটার হেটে আমি শহরের পশ্চিম প্রান্তে চলে এসেছি। এখন ফেরার পালা। একই ফুটপাথ ধরে আমি আবার পূর্ব দিকে হাঁটা শুরু করেছি।

বেশিরভাগ দোকান বন্ধ। রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ির সংখ্যা হাতেগোণা। ফেরার সময় আমার পূর্ব পরিচিত ‘পাই সানচেজের’ ‘এল-বাসেরো’ রেস্তঁরায় ঢুকলাম। দেখি- রেস্তরাঁর সবগুলো চেয়ার টেবিলের উপর তোলা। নিরাপদ দূরত্বে থেকে পাইকে হালহকিকত জিজ্ঞেস করলাম। এক সময় আমাদের হ্যাপি ডেইজ ডাইনারে সকালের শিফটে কাজ করত।

পাই বলল- রেস্তরাঁর একমাত্র ওয়েট্রেসকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে সপ্তাহ আগে। কেবলমাত্র ডেলিভারি সার্ভিস চালু আছে! স্ত্রী রাঁধে, নিজে ডিলিভারি দেয়। বলল, ইতোমধ্যে ব্যবসা লাটে উঠেছে। নেই বললেই চলে। বললাম- সরকার ছোটবড় ব্যবসায়ীকে ভর্তুকি দেবে, কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করো।

আমি পূর্বপ্রান্তে আমার গাড়ির কাছাকাছি ফিরে এসেছি প্রায়। এই হাঁটার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল- কেএফসিতে ঢুকে আজ কিছু ক্যালরি খাবার খাব। আমার প্রিয় একটি ডিশ- পট পাই। ঠাঠা গরম পট পাইয়ের বাটারি সরুয়ায় মুখ পুড়ে। তাই আমার প্রিয়। মাত্র সাড়ে ৫ ডলার দাম ট্যাক্সসহ।

রেস্তরায় বসে খেতে শুরু করেছি। আমি একাই খদ্দের। আর কেউ নেই। কেউ কেউ টেক আউট করছে ড্রাইভ ওয়ে থেকে। খাওয়ার মাঝামাঝি রেস্তরাঁ কর্মী বলল- ভেতরে বসে খাওয়া নিষেধ। স্বাস্হ্য বিভাগ নির্দেশ জারি করেছে- ভাইরাসের কারণে কেউ যেন ভেতরে বসে না খায়!

খেতে গিয়ে কাঁচের জানালা দিয়ে দেখি- পাশের গ্যাস স্টেশনের বেড়ার পাশে দুই যুবক-যুবতি। যুবকটি বেড়ার আড়ালে গিয়ে কিছুক্ষণ পরপর বিয়ারের ক্যান থেকে ঢুক ঢুক করে গিলছে, আবার ফিরে আসছে মেয়েটির কাছে।

ছেলেটিকে আমি চিনি। প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকে, গ্যাস স্টেশনের কোণায়, চৌরাস্তার মোড়ে। ভিক্ষে করে। টিভি খবরে দেখলাম- যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে অন্তত ৬০ হাজার হোমলেস লোক সর্বপ্রথম, আগামী সপ্তাহ দুই-এর মধ্যে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে।

আমার খাওয়া পর্ব শেষ হলে কেএফসির কর্মী মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভিক্ষুক দম্পতির কাছে এলাম। আজ ছেলেটির ভালো ভিক্ষে হয়নি নিশ্চিত। কারণ রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই, ভিক্ষে দেবে কে? তাই সে মনের সুখে বিয়ার খাচ্ছে, আর মেয়েটি কোলের কুকুরটিকে আদর করছে।

টম আর ক্রিস্টা, বন্ধু-বান্ধবী। জানালো দুই বছর ধরে একসঙ্গে থাকে। টম বারো বছর আগে নির্মাণ কোম্পানিতে কাজ করত। এরপর যে বেকার হলো, আর কাজ খোঁজে পায়নি। এরমধ্যে মাদকে আসক্ত হয়েছে। পুলিশের খাতায় নাম উঠেছে। তবে টমের ভাষ্য- এখন কেবল গঞ্জিকায় আসক্তি তার।

ক্রিস্টা ছিল একাউন্টিং কোম্পানিতে। দুই বছর আগে চাকরি হারানোর পর সামাজিক মাদক অনুষ্ঠানে পরিচয় টমের সঙ্গে এবং বন্ধুত্ব। টম আদর করে ডাকে ক্রেস্টা! কেউ একজন কুকুরটি দান করেছে ক্রেস্টাকে। কুকুরটি বামুন প্রজাতির হলেও একেবারে হাড়ভাঙা! ভাল খাবার জুটেনি মনে হয় অনেকদিন।

কুকুরটিকে এত আদর করতে দেখে ক্রেস্টাকে বললাম- আশা করি তোমারও একদিন এমন আদুরে সন্তান হবে। আমার কথা কেড়ে নিয়ে টম বলে- ‘আর হবে! ক্রেস্টার বয়স এখন ৫১! জিজ্ঞেস করলাম- তোমার কত? টম বলল- ৩৬।

জিজ্ঞেস করলাম- তোমার তো জন্ম এখানেই। তো কোনো কাজে যাচ্ছো না কেন? টমের উত্তর গাড়ি নেই। গাড়ি চালাতে গেলেই পুলিশ ধরে। ডিডব্লিউআই (Driving with Intoxicating)কেইস! তার ক্ষেত্রে পুলিশ সংবিধান লঙ্ঘন করছে উল্লেখ করে বলে- সংবিধান অনুযায়ী আমাকে গাড়ি চালাতে বাঁধা দেয়া উচিত নয়!

রাস্তায় কোনো লোক নেই। তাই টমের কোনো আয়ও নেই আজ। পকেট থেকে বের করে দেখালো মাত্র তিন-চার ডলার। বিয়ারের ক্যান কিনেছে হয়ত ১ ডলারে। আমি পেটপুরে খেলাম। টম-ক্রেস্টারও খাওয়া উচিত। তোমরা কিছু খেতে চাইলে আমি পয়সা দেব, বলে টমকে অনুসরণ করতে বললাম। টম আনন্দে লাফিয়ে আমার সঙ্গ নিল।

কেএফসিতে ঢুকে টমকে এক প্যাকেট চিকেন ফ্রাই দিতে বললাম। দুটি মানুষের জন্য পাঁচটি ফ্রাই কমপক্ষে ২ হাজার ক্যালোরি যোগাবে। তারমানে আজ আর কিছু না খেলেও চলবে। টমের সঙ্গে স্পর্শ কিংবা কর্মর্দনের সুযোগ নেই, নিরাপদ দূরত্বে থেকে বাই-বাই জানিয়ে বিদায় নিলাম।

পাঁচদিন আগে গত শুক্রবার বলেছিলাম- আমেরিকা কাঁপছে করোনায়। সেদিন পর্যন্ত মৃত্যু ছিল ৩৮। আজ সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৫-এ। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে! নিউইয়র্কে এক দিনের ব্যবধানে আক্রান্তের সংখ্যা ডাবল হয়েছে! আক্রান্তদের মধ্যে ২০% যাদের বয়স ২০ থেকে ৪৪ বছর।

worldometers.info বলছে- আজ ১৯শে মার্চ, সারাবিশ্বে মৃত্যুসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯,২৭৬-এ। ১৭৬টি দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ২,২৫,২৫৬। এদের মধ্যে আরোগ্যলাভ করেছে ৮৫, ৮৩১। ১,৩০,১৪৭ জন চিকিৎসাধীনের মধ্যে প্রায় ৭ হাজারের অবস্থা মারাত্মক।

বুধবার বিকেল পর্যন্ত নিউইয়র্কে ২,৩৮২ জন আক্রান্ত হয়েছে, যার মধ্যে আমাদের এই ডাচেস কাউন্টিতে ২০ জন রয়েছে। শুধু তাই নয়- যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সভা কংগ্রেসের দুই সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন।

কংগ্রেস ১ ট্রিলিয়ন ডলারের আপদকালীন সাহায্য তহবিল গঠন করছে। যার মধ্যে ৫০০ বিলিয়ন ডলার যাবে সরাসরি আমেরিকানদের কাছে। আমেরিকানরা দু’টো চেক পাবেন। একটি ৬ এপ্রিল, আরেকটি ১৮ মে। ৩০০ বিলিয়ন দেয়া হবে ছোট ব্যবসাগুলোকে। আর ৫০ বিলিয়ন দেয়া হবে এয়ারলাইনস ও ট্রাভেল কোম্পানিগুলোকে।

সব প্রতিষ্ঠানে লে অফ চললেও একমাত্র এমাজন লোকজন নিয়োগ দিচ্ছে উচ্চ বেতনে। গতকাল এমাজন ওয়্যারহাউজের একজন কর্মী আক্রান্ত হওয়ার খবরে কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়েছে। কেবল নিউইয়র্কে চাকরি হারানো লোকের সংখ্যা বেড়েছে ৪৫%।

নিউইয়র্কের হাসপাতালগুলোতে খুব শিগগির রোগীর সুনামি শুরু হবে বলে আশংকা করছেন চিকিৎসা সেবার লোকজন। গতকালও ইতালিতে ৩৪৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ইতালির মৃত্যু চায়নাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে! তবে সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ হলো ইতালির এই পরিস্থিতি থেকে আমেরিকা মাত্র দুই সপ্তাহ দূরে!

প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। ৩০% হারে। মহামারি বিশেষজ্ঞ নীল ফার্গুসন বলেছেন- যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই ২২ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটতে পারে। প্রেসিডন্ট ট্রাম্প নিজেকে ওয়ারটাইম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আগামী ১৫ দিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নৌবাহিনীর দু’টি বিশেষায়িত জাহাজ হাসপাতাল পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলের দু’টি রাজ্য যথাক্রমে ক্যালিফোর্নিয়া ও নিউইয়র্কের দিকে রওয়ানা হয়েছে। এগুলো উপকূলে পৌঁছাতে এখনো দুই সপ্তাহ বাকি।

এদিকে নিউইয়র্ক সিটির নিউরোশেলে গতকাল থেকে প্রথমবারের মত “ড্রাইভ থ্রো” করোনা টেস্টিং শুরু হয়েছে। এটিকে সারাদেশে ব্যাপকতর করার প্রস্তুতি চলছে।

নিউইয়র্ক শেয়ার বাজার উঠেছিল ২৮ হাজারের উপর। করোনা প্রভাবে এখন নেমে এসেছে ১৯ হাজারের কোঠায়। প্রতিদিন ৮-৯% করে নামছে। শেয়ার বাজার মানেই অর্থনীতি নয়। কিন্তু অর্থনীতি এরচেয়ে খারাপ হওয়ার আশংকা রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দুষছে মিডিয়া। তারা বলছে- শুরুতে ট্রাম্প “চায়নিজ ভাইরাস” বলে ব্যাঙ্গ না করে অর্থ বরাদ্দ করা উচিত ছিল। বিশ্ব এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি সংযুক্ত। চায়না কিংবা ইতালিতে রোগের বিস্তার মানে আমেরিকা কিংবা বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত আক্রান্ত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

তবে করোনায় সবাই মরে না। ৮০-৯০ ভাগই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে। শরীরে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, তারা উতরে যেতে পারে। পর্যাপ্ত পানি পান, ভাইটামিন সি গ্রহণ করলে, স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা কম। পর্যাপ্ত ঘুম এবং ব্যায়াম, দৌড়ানো কিংবা সচল থাকা এ সময়ের আবশ্যকীয় শর্ত।

নিউইয়র্ক, ১৯শে মার্চ ২০২০।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর