১২ এপ্রিল, ২০২০ ১৪:৪৮

স্বাস্থ্যখাতই হবে ভবিষ্যতের মূল প্রতিরক্ষা খাত

মিনার মুনসুর

স্বাস্থ্যখাতই হবে ভবিষ্যতের মূল প্রতিরক্ষা খাত

মা ছিলেন স্বশিক্ষিত। বাড়তি গুণ ছিল তাঁর সহজিয়া খোলা মন এবং বইয়ের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ। হাতের কাছে যা-ই পেতেন, তাই পড়তেন। পড়তেন অত্যন্ত দরদের সঙ্গে। বইকে তিনি ধর্মগ্রন্থের মতোই শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। সব মিলিয়ে, ভাবুকতা ও দার্শনিকতার মিশেলে তাঁর মধ্যে সন্ত বা দরবেশসুলভ এক ধরনের দূরদৃষ্টি তৈরি হয়েছিল- যা আমাকে এখনো বিস্ময়াভিভূত করে।

তো কোনো সংকটে-দুর্বিপাকে আমরা যখন দিশেহারা হয়ে পড়তাম, মা আশ্চর্য শান্ত স্বরে বলতেন, ‘বিপদকে ভয় করিস না। এটাও আল্লাহর এক ধরনের রহমত।’

কখনো কখনো খানিকটা বিরক্ত হয়ে আমি হয়ত জিজ্ঞেস করে বসতাম, সেটা কী রকম? মা হেসে বলতেন, ‘বুঝিস না, বিপদের কাঁটায় মোড়া মিষ্টি ফলের মতো তিনি রহমতের বার্তা পাঠান।’ তখন অতো বুঝতাম না, এখন বুঝি।

জ্ঞানীরা কথাটা অন্যভাবে বলেন। তাদের মতে, সব সংকটের মধ্যেই উপ্ত থাকে নতুন সম্ভাবনার বীজ। সেটাকে ঠিকমতো কাজে লাগানো গেলে খুলে যেতে পারে অমিত সম্ভাবনার এমন কোনো সোনালি দিগন্ত-যা আমরা কল্পনাও করিনি। আমার মনে হয়, করোনাও আমাদের জন্যে এমন কিছু সম্ভাবনার বীজ বহন করে এনেছে- যা করোনাউত্তর পৃথিবীর জন্যে বিশল্যকরণী হিসেবে কাজ করতে পারে। তার কিছু কিছু লক্ষণ ইতোমধ্যে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। তার মধ্যে নিঃসন্দেহে প্রথম ও প্রধান হলো- পরিবেশের সুরক্ষা। করোনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে মানুষকে ছাড়াই প্রকৃতি ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে। মানুষ তার অস্তিত্বের জন্যে অপরিহার্য় তো নয়ই, বরং ক্ষতিকর। পক্ষান্তরে, মানুষ প্রকৃতিকে ছাড়া একমুহূর্তও বাঁচতে পারে না। অতএব, ট্রাম্পসাহেবরা যাই বলুক, বাঁচতে হলে মাতৃজ্ঞানে প্রকৃতিকেও বাঁচাতে হবে। এটাই হওয়া উচিত আগামী পৃথিবীর প্রথম অগ্রাধিকার।

করোনার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি হলো, যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি তা দিয়ে ই্‌উরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশও যেখানে তার জনগণকে সুরক্ষা দিতে পারেনি, সেখানে ভারত-বাংলাদেশসহ তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোর অবস্থা সহজেই অনুমেয়। বিল গেটসসহ অনেকেই বহু আগে থেকেই বলে আসছেন যে করোনার মতো নতুন নতুন ভাইরাসরা আসতেই থাকবে। অতএব, স্বাস্থ্যখাতই হবে ভবিষ্যতের মূল প্রতিরক্ষা খাত। মূল বিনিয়োগটা করতে হবে সেখানেই। স্বাস্থ্যখাতের খোলনলচে বদলাতে হবে। সম্ভাব্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সামরিক বাহিনীর আদলে গড়ে তুলতে হবে স্বাস্থ্যখাতকে। সারা পৃথিবীর জন্যে অভিন্ন ও সর্বজনীন একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ শুরু করতে হবে এখন থেকেই।

মাকে খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে সেই গ্রামকে- যা শৈশবে মায়ের মতোই কাছে টানতো আমাকে। কী প্রশান্ত মায়াময় ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল সেই গ্রাম! সব তছনছ করে নিজেদের কংক্রিটের খাঁচায় অবরুদ্ধ করে ফেলেছি আমরা। গতকাল সন্ধ্যায় ক্রুদ্ধ কালবৈশাখীর আর্তনাদ শুনেছি। তার গর্জন শুনে মনে হচ্ছিল, কংক্রিটের এই খাঁচা ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চায় সে। কিন্তু পারছে না। সকালে ছাদে গিয়ে দেখি, আশ্চর্য এক প্রশান্তি চারিদিকে। আমার নজর কেড়ে নেয় দারুচিনি দ্বীপের মতো একখণ্ড সবুজ। কিন্তু মাথা তুলতেই দেখি, যতদূর চোখ যায় কেবল বিল্ডিং আর বিল্ডিং… কল্পবিজ্ঞানের মানববিধ্বংসী এলিয়েনের মতো কী আগ্রাসী তার অবয়ব! ভাবি, করোনা যদি নাও আসতো তাহলেও কি আমরা পরিত্রাণ পেতাম?

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক: জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর