২০ এপ্রিল, ২০২০ ০৮:২২

বাঁচার একটাই ওষুধ, জাস্ট ঘরে থাকুন, ঘরে থাকুন এবং ঘরে থাকুন

পিনাকি তালুকদার

বাঁচার একটাই ওষুধ, জাস্ট ঘরে থাকুন, ঘরে থাকুন এবং ঘরে থাকুন

আমার ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে আজ কথা বলবো। ৪ এপ্রিল রাত প্রায় ১০টার দিকে আমাদের মেয়ে পরমা তালুকদার পার্ল হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার বয়স ১৪ মাস পূর্ণ করে ১৫ মাস চলছে। সারাদিন সে হয়তো হালকা জ্বরে আক্রান্ত ছিলো। আমরা আসলে বুঝতেই পারিনি। বিকালে ঘুম থেকে উঠার পর সন্ধ্যায় সে খেলাধুলা করছিলো অন্যান্য দিনের মতোই। কিন্তু রাত প্রায় ১০টার দিকে তার মায়ের বুকের দুধ খাওয়া অবস্থায় হঠাৎ করেই সে আনকনসাস হয়ে পড়ে। সে কোনো ধরনের মুভমেন্ট করছিলো না। কান্নাও করছিলো না। আমরা তো মূহুর্তেই দিশেহারা হয়ে গেলাম। আমার স্ত্রী (সেঁজুতি তালুকদার) কান্না শুরু করে দিয়েছেন। প্রথমে আমি মেয়েকে কোলে নিয়ে, চোখে মুখে পানি দিলাম। তারপর সোফায় রেখে একটু ডাকলাম। কোনো সাড়া শব্দ নেই। সে শুধু তাকিয়ে আছে। অন্যমনষ্ক ভাবে। এভাবে দুই তিন মিনিট দেখার পর ছোট ভাই (পরিমল তালুকদার) বলল তাড়াতাড়ি ৯১১ এ কল কর। আমিও কল করলাম। কল করার পর আমার বর্ণনা শুনে প্রায় ৩ মিনিটের মধ্যে এ্যাম্বুলেন্স হাজির হলো। পরবর্তী ২ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছাল। সব মিলে ৬ মিনিটের বেশি লাগেনি। কারণ আমাদের কাছে তখন এক সেকেন্ড কে অনাদি কাল মনে হচ্ছিল। জ্যামাইকার কুইন্স হাসপাতালটি আমাদের বাসার কাছেই। হাসপাতালে যেতে যেতেই পুলিশ হাসপাতালে জানিয়ে দিয়েছেন। তার আগে মেয়ের মুখে একটা অক্সিজেন লাগিয়ে দিলেন। আর আমার কাছে কেবল মেয়ের নাম আর জন্ম তারিখ জেনে নিয়েছেন।

হাসপাতালে পৌঁছা মাত্রই চার -পাঁচজন ডাক্তার, নার্স মেয়ের চিকিৎসা শুরু করে দিলেন। তখনও আমাদের মেয়ের কোনো মুভমেন্ট নেই। আমরা কেবল তাদের চেষ্টা দেখছি। এভাবে প্রায় ১০ মিনিট পর আমাদের মেয়ে একটু একটু করে কান্না শুরু করলো। এই প্রথম আমার আত্মায় শান্তি পেলো। তখনি আমার মনে হলো আর সমস্যা হবে না। এবার পুলশ সদস্যরা বিদায় নিলেন। তাঁদেরকে প্রাণভরে ধন্যবাদ জানালাম। হয়তো তারা অন্য কারো বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়বেন আবারো!

এরপর একে একে মেয়ের রক্ত, ইউরিন, করোনা পরীক্ষা ও এক্সরে করা হলো একটু সেলাইনও দেয়া হলো। একই সাথে চলল বারবার জ্বর মেপে দেখার কাজও। মেয়ে আস্তে আস্তে কান্নার আওয়াজ বাড়াচ্ছে। আমার মনোবলও যেন বাড়ছে।

ডাক্তারের বক্তব্যে জানলাম, এটাকে বলে সিজার (Febrile Seizure)। অর্থাৎ জ্বর হঠাৎ করে বেড়ে গেলে বাচ্চাদের এটা হতে পারে। ফিবার থেকে সিজার। বাচ্চাদের জ্বর হলে খুব সাবধান থাকতে হবে যেন না বাড়ে।

কুইন্স হাসপাতাল তখন ভয়াবহ একটা মৃত্যুপুরী। টানা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই ৮০০/৯০০ করে মানুষ করোনার ছোবলে মারা যাচ্ছেন কেবল নিউ ইয়র্কেই। এলমহাস্ট্রের পরই কুইন্স হাসপাতালের চিত্র ভয়াবহ। গভীর রাতেও আমি দেখছি পাশ দিয়ে কেবল সাদা কাপড়ে ঢাকা একটার পর একটা ট্রলি যাচ্ছে। আমি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে স্ত্রীকে শক্ত করে ধরে অপেক্ষা করছি রিপোর্টের জন্য।

প্রায় দুই ঘণ্টা পর সব রিপোর্ট নিয়ে মহিলা ডাক্তার আমাদের কাছে আসলেন। রিপোর্টের কপি আমাদের হাতে দিয়ে বললেন সব ঠিক আছে। আর কয়েক ঘণ্টা জ্বরটা দেখবো । তারপর আপনারা বাসায় যেতে পারবেন। আমাদের মেয়ের ট্রিটমেন্ট হয়েছে জরুরি বিভাগের একদম আলাদা একটি রুমে। কারণ হাসপাতালের সমস্ত করিডোর পর্যন্ত করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

ততক্ষণে আমাদের কলিজার টুকরা মেয়ে খেলাধুলা শুরু করে দিয়েছে। এ সময় যে নার্স আমাদের মেয়ের সার্বক্ষণিক দায়িত্বে ছিলেন, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোথায় থাকেন? তিনি জানালেন, আমি লুইজিয়ানা থেকে এসেছি। আপনাদের নিউইয়র্ককে সেবা দিতে। আমার যেন, আবারো চোখে জল চলে এলে। জানলাম, তিনি বাড়িতে ১৮ মাসের মেয়েকে রেখে এসেছেন নিউইয়র্কের পাশে দাঁড়াতে। আমি গভীর শ্রদ্ধায় তার সম্মুখে নত হলাম।

নিজের ১৮ মাসের সন্তানকে রেখে যে মা একটি মৃত্যুপুরীতে আসতে পারেন, কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে। তাকে আপনি কি বলবেন?
এরাই অ্যামেরিকার মহামানব। এটাই মহান অ্যামেরিকার সংস্কৃতি। হাসপাতালের ভয়াবহ সেই মধ্যরাতের পরিস্থিতিতে উনার নামটাও জানা হলো না। একটা ছবিও তুলে রাখতে পারলাম না। তখনই ঠিক করলাম, আমি অবশ্যই লুইজিয়ানা দেখতে যাবো। এতো মহৎ হৃদয়ের মানুষ যেখানে বাস করেন, সেই পূণ্য ভূমিতেই আমি যেতে চাই।

প্রায় ৫ ঘণ্টা শেষে আরো কয়েকবার জ্বর মেপে দেখে ভোর ৫টার দিকে আমরা বাসায় ফিরলাম। একটা উবার নিয়ে। এর আগে বেশ কয়েকজনকে ফোন করলাম। কাউকে না পেয়ে উবারেই উঠতে হলো। গাড়িতে উঠার আগে ড্রাইভার ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম উনার গাড়িতে কোনো পেশেন্ট উঠেছে কিনা। উনি আশ্বস্থ করলেন। তারপরও এলকোহলযুক্ত টিস্যু দিয়ে সিটগুলো একটু পরিষ্কার করলাম।

আমাদের পারিবারিক অভিজ্ঞতাটা প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করলাম উপরের শিরোনামটার ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য। ডাক্তার কিছু ওষুধ দিয়েছেন পরের দিন ফার্মেসি থেকে আনার জন্য। এই টোটাল প্রক্রিয়ায় আমাদের খরচ হয়েছে শুধু উবার ভাড়াটা।

ডাক্তার বলে দিয়েছেন, পরের দিন যেন মেয়ের প্রাইমারি ডাক্তারকে সব জানাই। পরের দিন সকালে প্রাইমারি ডাক্তার সব শুনে কয়েকদিন পর তাদের কাছে যেতে বললেন। একই সাথে একজন সিজার বিশেষজ্ঞের নাম্বার দিলেন যোগাযোগ করার জন্য।

অনেকেই বলছেন, অ্যামেরিকার মতো এতো উন্নত দেশে এতো মানুষ মারা যাচ্ছেন কেন? আমার মতে এর প্রধান কারণ হলো যে হাসপাতালে রোগীর ধারণ ক্ষমতা আছে ৫০০ জনের। সেখানে এখন এই মহামারীতে সেবা দিতে হচ্ছে ৫০০০ জনের। এই মহাসংকট মোকাবেলা আরো ভয়ংকর।

এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন ভাবছি, বাংলাদেশে যদি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে, তা হলে কি হতে পারে। এখন মৃত্যুপুরী নিউইয়র্কের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, যারা ঘরে আছেন তারাই সুস্থ আছেন। যারাই বাইরে যাচ্ছেন, তারাই ঝুঁকিতে পড়ছেন।

বাংলাদেশের মানুষের এখন বাঁচার একটাই ওষুধ, জাস্ট ঘরে থাকুন। ঘরে থাকুন এবং ঘরে থাকুন।

আমাদের মেয়ে এখন পুরোপুরি সুস্থ আছে। আমি অন্তর থেকে চাই, পৃথিবীর সকল শিশু এই কঠিন পৃইথবীতে সুন্দর ভাবে মা-বাবার পরম আদরে বেড়ে উঠুক, বেঁচে থাকুক। সবার কল্যাণ কামনা করছি।

লেখক: আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর