২১ এপ্রিল, ২০২০ ০৯:৫৬

আমার উদ্যোক্তা হয়ে উঠার গল্প

জিনাত সুলতানা

আমার উদ্যোক্তা হয়ে উঠার গল্প

জিনাত সুলতানা

আমি জিনাত সুলতানা। রাঙ্গামাটিতে জন্মস্থান হওয়ার সুবাদে শৈশব কৈশোর সবকিছু প্রকৃতির সান্নিধ্যে অর্জন করার সুযোগ হয়। সে সুবাদে রাঙ্গামাটি সরকারি স্কুল থেকে ২০১০সালে এসএসসি এবং রাঙ্গামাটি সরকারি মহিলা কলেজ থেকে ২০১২ সালে এইসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হই। কিন্তু ২০১৩ সালে হঠাৎ মমতাময়ী মায়ের মৃত্যুতে আমি সম্পূর্ণ দিশেহারা হয়ে পড়ি। একপর্যায়ে চট্টগ্রাম কলেজে অনার্স ১ম বর্ষে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে জীবন সংসার কি সেটা বুঝার আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। তারপর পাহাড় লেকের মায়াবী বন্ধন ছেড়ে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আরেক মায়ার শহর চট্টগ্রামে চলে আসি। ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন ছিল বিধায় মনের মতন জীবনসঙ্গী পেয়ে গেলাম।

২০১৫ সালের শেষ দিকে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা দেওয়ার সাথে সাথে স্বামীর সহযোগিতায় চট্টলা হাট ডট কম নামে অনলাইন শপের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা শুরু। তারপর ই-কমার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজীব আহমদ স্যারের অনুপ্রেরণায় ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার হই। এর কিছুদিন পর IIUC এর ফিমেল ক্যাম্পাসে ওমেন প্রোডাক্টস নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়।

কিন্তু সন্তানের মা হবার কারণে ২০১৬ সালে তা আর কন্টিনিউ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে অর্গানাইজেশন অব দ্য ইউনাইটেড ন্যাশনস (ফাও) এর অধীনে পরিচালিত ফরেন এনজিও সাথে "পুষ্টি ও ভেজাল পণ্য" নিয়ে কাজ করার বিরল সুযোগ অর্জন করি। যেটা বলতে গেলে আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। প্রজ্ঞা ও মেধার অপূর্ব মেলবন্ধনের মাধ্যমে মেধার সর্বোত্তম বিকাশের সুযোগ পাই।

সেখানে এনজিও টিমের সাথে বিভিন্ন জায়গায় সরেজমিনে সমীক্ষা করতে গিয়ে দৃষ্টিগোচর হয় বাংলাদেশের রান্নার মসলা পণ্য লোকাল মার্কেট থেকে শুরু করে নামীদামী ব্র্যান্ড পর্যন্ত ৯০% ভেজাল। তারপর তাদের সাথে আমার যৌথভাবে শুরু হয় দেশী-বিদেশী ৭৮ প্রকার মসলা পণ্য নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা। মসলা নিয়ে যত গভীরে যাচ্ছি ততই রহস্য উন্মোচন হচ্ছে দিবালোকের মতন।

ফলশ্রুতিতে আমার কাজ করার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ফরেন প্রতিনিধির কাছ থেকে মসলার উপর যত টেকনিক্যাল জ্ঞান, মসলা পরিচিতি এবং কিভাবে মসলার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ভর করে সবকিছুর উপর প্রাকটিকাল ও থিউরিটিকাল অভিজ্ঞতা অর্জনের আমার বিরল সুযোগ হয়। এরই মধ্যে আমি "বাংলার মসলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য" নামে সুদীর্ঘ গবেষণালব্দ বইয়ের পান্ডুলিপি সমাপ্ত করি, প্রায় প্রকাশিত হওয়ার পথে।

ছোট বেলায় রাঙ্গামাটি আর্মি ক্যাম্পের আর্মিদের প্রশিক্ষণ দেখে আমার মনের মাঝে উঁকি দিত একদিন আর্মিদের প্রশিক্ষক হব আর চট্টগ্রাম কলেজে পড়া অবস্থায় স্যারদের দেখে আমার স্বপ্ন জাগত আমিও একদিন ডায়াসে দাঁড়িয়ে লেকচার দিব।

২০১৮সালে ফেব্রুয়ারি মাসে অনার্স রেজাল্ট প্রকাশিত হবার সাথে সাথে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য চট্টগ্রামের বেশিরভাগ কলেজ অধ্যক্ষের সাথে গেস্ট শিক্ষক হিসেবে সুযোগ দেওয়ার জন্য যোগাযোগ করি। কিন্তু মাস্টার্স না থাকায় কেউ সুযোগ দিতে রাজি হয়নি।

অবশেষে আবারও ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন ছিল, তাই রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজের শ্রদ্ধেয় প্রিন্সিপাল স্যার আমার মতন একদম অনভিজ্ঞকে গেস্ট টিচার হবার সেই বিরল সুযোগ দিল। কিন্তু শর্ত দিল অবৈতনিকভাবে পড়াতে হবে আর ক্লাস নিতে হবে দুপুরের পর। আমি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য স্যারের সব শর্ত বিনাবাক্যে মেনে নিয়ে ঐতিহাসিক সুযোগ গ্রহণ করলাম।

ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ ৭মাস পর আমি সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের সরাসরি বাংলা লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হই।

আপনারা শুনলে আশ্চর্য হবেন যে, আমি এই অল্প সময়ে যেই কলেজে নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েছি সব জায়গায় ভাইবা পর্যন্ত যেতাম কিন্তু মাস্টার্স না থাকায় জয়েন করার সুযোগ হত না। অবশেষে মাস্টার্স রেজাল্ট বের হবার সাথে সাথে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ২০২০সালে আমি সাউথ এশিয়ান কলেজ চট্টগ্রামে বাংলা লেকচারার হিসেবে জয়েন করি।

শেষ পর্যন্ত আমার দুই স্বপ্নই পূরণ হল। আল্লাহর অশেষ রহমতে বর্তমানে আমি সামরিক বেসামরিক মিলে দুই কলেজে অধ্যাপনা করছি।

তারপর ২০১৯ সালের অক্টোবরে উই'তে যুক্ত হই। এরপর ভেজাল মসলা সম্পর্কে ভোক্তাদের সচেতন করার জন্য ডিসেম্বর মাসে "রন্ধন মসলা" নামে অনলাইন শপ প্রতিষ্ঠা করি। যেখান থেকে একদিকে লেখার মাধ্যমে বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল মসলা সম্পর্কে ভোক্তাদের সচেতনতা তৈরি করি এবং অন্যদিকে বিশ্বস্ততার সাথে ভোক্তাদের কাছে "রন্ধন মসলার" স্বাস্থ্যসম্মত মসলা পণ্য সারা বাংলাদেশে সরবরাহ করি।

আলহামদুলিল্লাহ খুব অল্প সময়ে "রন্ধন মসলা" ভোক্তাদের অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে। ভবিষ্যতে "রন্ধন মসলা" সম্পূর্ণ অর্গানিক পদ্ধতিতে "রন্ধন মসলা পার্ক" থেকে প্রত্যেকটা মসলা পণ্য বাংলাদেশে উৎপাদন করে সারা পৃথিবীতে নির্ভরযোগ্য মসলার ব্র্যান্ড হিসেবে গৌরব অর্জন করবে সেই লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।

লেখক: ফাউন্ডার, রন্ধন মসলা।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর