২ মে, ২০২০ ১১:৩০

যুবকটি বাঁচতে চেয়েছিল

অনলাইন ডেস্ক

যুবকটি বাঁচতে চেয়েছিল

সাংসদ ইসরাফিল আলম

করোনাভাইরাসের কারণে লাখ লাখ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে। তেমনই এক হতভাগ্য যুবককে নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন নওগাঁ-৬ (আত্রাই-রাণীনগর) আসনের সাংসদ ইসরাফিল আলম। তিনি তার নির্বাচনী এলাকা রানীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের জালালাবাদ গ্রামের সোহেল রানা (৩২) নামে এক খেটে খাওয়া যুবককে নিয়ে বুধবার (২৯ এপ্রিল) তার ফেসবুক আইডিতে হৃদয়বিদারক তথ্য তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন: 

যুবকটি বাঁচতে চেয়েছিল।

বিচিত্র এই পৃথিবীর বিচিত্র সব মানুষ। তার চেয়েও বিচিত্র মানুষের জীবন এবং জীবনের গল্পগুলো। ছেলেটি বাঁচতে চেয়েছিল এই সুন্দর পৃথিবীতে। অনেক ধনী বা বিত্তশালী হিসেবে নয়, দুবেলা খেয়ে পরে দিনমজুর হিসেবে। কিন্তু নিয়তি সেই সুযোগটুকু তাকে দেয়নি। বড়ই মর্মান্তিক আর হৃদয়বিদারকভাবে তাকে চলে যেতে হল এই সুন্দর পৃথিবীর সকল মোহ মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে।

ওর জন্মস্থান আমার নির্বাচনী এলাকার রানীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের জালালাবাদ গ্রামে। নাম সোহেল। ওরা ৩৫ জন খেটে খাওয়া মানুষ জীবিকার সন্ধানে গিয়েছিল সাভারের হেমায়েতপুরে। করোনাভাইরাস জনিত মহামারীর কবলে পড়ে স্তব্ধ হয়ে যায় তাদের কর্মমুখর জীবন, সেই সাথে থেমে যায় তাদের জীবিকার পথ।

গতকাল সকালে ওদের মধ্যে উদ্যমী এবং অনেকটা দলনেতা প্রকৃতির আরেক যুবক সাগর সর্দার আমাকে ফোন করে জানালো -"আমরা আপনার নির্বাচনী এলাকার জালালাবাদ গ্রামের বাসিন্দা, সাভার হেমায়েতপুরে কাজ করতে এসেছিলাম। লকডাউন এর কারণে ঘর থেকে বের হতে পারিনা। তাই কাজ বন্ধ, জমানো টাকা পয়সা শেষ। গতকাল সারাদিন আর সারারাত না খেয়ে আছি আমরা। এখানে থাকলে না খেয়ে মারা যাবো । তাই অনুরোধ করছি আঙ্কেল আমাদেরকে সাহায্য করেন, আমরা গ্রামে ফিরে যেতে চাই।"

কথা বলে জানলাম, ওরা নওগাঁর একটি ট্রাকের সাথে যোগাযোগ করেছে। ট্রাকটি কাঁচা তরিতরকারিসহ কাওরান বাজার গেছে । ফেরার পথে ওদেরকে নিয়ে নওগাঁ এসে নামিয়ে দেবে। এখন তাদের জীবন রক্ষা করতে খাবারের জন্য ৫ হাজার টাকা দরকার। আমি ওদের দেওয়া বিকাশ নাম্বারে ০১৩০৯২৫০৮৬৮ বিআরডিবির মামুনের মাধ্যমে ৫০০০ টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বললাম "দ্রুত গ্রামে ফিরে আসো, এখানে ইরি ধান পেকে গেছে, কেটে ঘরে তোলার জন্য অনেক মানুষ দরকার"।

তারা টাকা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা, ওদের মধ্যেকার এক বৃদ্ধ চাচা আবেগাপ্লুত হয়ে আমার সাথে কথা বললো । ভিডিও কলে কথা বলার জন্য অনেক অনুরোধ করল কিন্তু আমার ত্রাণ সম্পর্কিত কর্মব্যস্ততার কারণে আমি ভিডিও কলে কথা বলতে পারিনি। বলেছি "এলাকায় আসো সবার সাথে দেখা হবে কথা হবে"।

সাগরসহ দুইজন ওই টাকায় বাজার করে বস্তিতে ফিরছিল। রাস্তা ছিল ফাঁকা। রাস্তাটি পার হওয়ার সময় পেছন থেকে একটি দ্রুতগামী মাইক্রোবাস এসে ধাক্কা দিয়ে একজনকে রাস্তার ধারে ছিটকে ফেলে দেয় । ওর মাথায় প্রচন্ড আঘাত লাগে। ওরা তাৎক্ষণিক ছেলেটিকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চলে যায়। কর্তব্যরত ডাক্তার রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে ভর্তি করতে অসম্মতি যাপন করে। আমি টেলিফোনে অনুরোধ করার পর ডাক্তার তাকে ভর্তি করতে ও চিকিৎসা দিতে রাজি হয়। কিন্ত তিন ব্যাগ জরুরী রক্তের প্রয়োজনীয়তার কথা জানায়। আমি রক্ত কেনার জন্য ও কিছু ওষুধ কেনার জন্য আবার ১০ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে সাগর সরদার এর কাছে পাঠিয়ে দিই। এবং চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকি ।ইতিমধ্যেই রাণীনগর থানার ওসি সাহেবের সাথে ওদের যোগাযোগ করিয়ে দিই ,যাতে রাস্তায় আসার পথে কোন ঝামেলায় পড়তে না হয়।

আত্রাই থানায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সাথে ইফতারি করতে যাই। ইফতারের পূর্ব মূহূর্তে জানতে পারি ছেলেটি মৃত্যুবরণ করেছে । ডাক্তার সাহেবের সাথে কথা বলে অ্যাম্বুলেন্সে মাধ্যমে দ্রুত লাশ তার বাবা-মার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। উনারা টাকা চাইলে আবারো ১০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিই যুবলীগ নেতা ফিরোজ এর মাধ্যমে। পথ খরচের জন্য পরবর্তীতে আরও দুই হাজার টাকাপাঠিয়ে দিই।

আজ মৃত ছেলেটি বাবা-মা ও আপনজনদের কাছে ফেরত আসবে লাশ হয়ে । অথচ আসার কথা ছিল পকেট ভরা টাকা আর হাসিখুশি মনে । কারণ রমজানের কয়দিন পরে ঈদের উৎসব আনন্দ। বড়ই বেদনার যুবকের মৃত্যুর ঘটনাটি।
সে বাড়ি ছাড়া হয়েছিল নিজে বাঁচতে এবং পরিবার-পরিজনকে বাঁচাতে জীবিকার তাড়নায়। করোনাভাইরাসের কারণে তাকে প্রথমে হতে হলো কর্মচ্যুত। তারপর আয় উপার্জন হয়ে গেল বন্ধ। বন্ধ হয়ে গেল তার জীবিকার চাকা । তারপর পুরো একটি দিন ও রাত অভূক্ত থাকা। আর সেই অভুক্ত অবস্থায় শেষ বিদায় নিয়ে এই পৃথিবী থেকে তার প্রস্থান।

দেশে কত খাবার, কত অর্থ-সম্পদ আর ধণাঢ্য মানুষের বসবাস হেমায়েতপুর-সাভার এর জনপদে । কিন্তু সেখানেই থাকতে হয় কত মানুষকে অভুক্ত।  আবার সেখান থেকেই ফিরে আসতে হচ্ছে নিরুপায় মানুষগুলোকে নিজ গ্রামে শুধু মাত্র বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাকে বুকে নিয়ে।

একটু ভেবে দেখুন তো বন্ধুরা! সামান্য কদিনের প্রতিকূলতার মধ্যেই কি নিদারুণ বিপন্ন হয়ে গেছে আমাদের সভ্যতা সমৃদ্ধি আর প্রবৃদ্ধি অহংকার। এখনো অনেক দূর যেতে হবে আমাদেরকে একটি ক্ষুধামুক্ত মানবিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য- যে সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিতে হয়েছে ৩০ লক্ষ মানব সন্তানকে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ উৎসর্গ করতে হয়েছে লাখ লাখ মা বোনকে। সপরিবারে জীবন দিতে হয়েছে এই রাষ্ট্রের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় নিহত হতে হয়েছে চার জাতীয় নেতাকে।


বিডি প্রতিদিন/ফারজানা 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর