৩ মে, ২০২০ ১২:৩৪

আমরা এখন কত অল্পতে আনন্দিত হয়ে উঠি!

রিমি রুম্মান (কুইন্স, নিউইয়র্ক)

আমরা এখন কত অল্পতে আনন্দিত হয়ে উঠি!

রিমি রুম্মান

লকডডাউনের ষষ্ঠ সপ্তাহ অতিক্রম করছি আমরা। চশমার দোকান থেকে ফোন আসে। তরুণীর মিষ্টি কণ্ঠস্বর, ‘ রুম্মান, তোমার অর্ডার রেডি, এসে নিয়ে যাও।’ বাহ্‌ চশমার দোকান খুলেছে ! ভেতরটায় দারুণ এক আনন্দ খেলে গেল। আমরা এখন কত অল্পতে আনন্দিত হয়ে উঠি! 

আনন্দ হবেই বা না কেন ? একমাসেরও অধিক সময় নগরীর দোকানপাট বন্ধ। চারিদিকে শুধু দমবন্ধ এক খাঁ খাঁ শূন্যতা। ভাবতে ভাবতে ফোনটা রাখতে যাচ্ছিলাম। অমনি মেয়েটির স্বর ভেসে আসে, ‘ শুনো, আসার সময় অবশ্যই মাস্ক পরে আসবে, কেমন?’ আমি ‘ নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই’ বলতে বলতে ফোন রাখি। 

বিকাল চারটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। হাতে সময় কম। মাস্ক যা ছিল, শেষ হয়ে গিয়েছে। ঝটপট ইউটিউব দেখে দু’জনের জন্যে দুটি মাস্ক বানিয়ে নিলাম। নীল রঙের মাস্ক মুখে চেপে ছুটলাম আমরা। শ্বেতাঙ্গ তরুণী অর্ধেক শাটার টেনে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। জিনিস বুঝিয়ে দিলেন। বার কয়েক হাত জীবাণুমুক্ত করলেন হ্যান্ড সেনিটাইজার দিয়ে। পরিচ্ছন্নতার দারুণ এক অভ্যাস গড়ে উঠেছে শহরের মানুষজনের।

বাড়ির বাইরে বেরুতে তুমুল প্রস্তুতি নিতে হয় ইদানিং। অনেকগুলো কাজ একসাথে জড়ো হলে তবেই বাইরে যাবার পরিকল্পনা করি। কিন্তু আজ চশমার দোকানে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও কাজ নেই। তাই উদ্দেশ্যহীন ঘুরছি। রেকর্ড প্লেয়ারে গান বাজছে, ‘ যেভাবে বাঁচি, বেঁচে তো আছি, জীবন আর মরণের মাঝামাঝি ...’ চমৎকার সুরেলা কণ্ঠ! 

পঁচিশ বছর পার করেছি এই শহরে। এক জীবনের হিসেবে অনেক সময়। সময়গুলো রুদ্ধশ্বাসে, তুমুল ব্যস্ততায় চলে গেছে জীবন থেকে। শহরের সড়কে কতো শত, হাজারবার চলাচল করেছি বিগত দিনে, কিন্তু এমন গভীর মনোযোগে চারপাশটা দেখার ফুসরৎ হয়নি কোনওদিন। কুইন্স ব্লুবার্ডের প্রশস্ত রাস্তা ধরে ধীর গতিতে এগোচ্ছি। দুইপাশের বন্ধ দোকানপাট দেখছি। এই তো সেদিনও ব্যস্ততা থেকে পালাতে চেয়েছিলাম। নির্জন এক জীবন চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম প্রগাঢ় একাকীত্ব। ক্লান্তিহীন নিশ্চিন্ত দীর্ঘঘুম। তবে? কেন গভীর এক বেদনা গ্রাস করে আছে মনে? শাঁ করে ডান-বাঁয়ের লেন দিয়ে পাশ কেটে দ্রুতগতিতে চলে যাওয়া গাড়ির শব্দে মনোজগতের ভাবনায় ছেদ পড়ে। তবে কি জীবন আগের গতিতে ফিরেছে? আগের সেই ব্যস্ততা, শাঁ শাঁ করে ছুটে চলা! অগণিত মানুষের কোলাহল! এক্সিট নেবার জায়গাটিতে ট্রাফিক জ্যাম চোখে পড়ে।  বিরক্তির পরিবর্তে আনন্দ খেলে যায় অজান্তেই। আহা ট্রাফিক জ্যাম! আহা ছন্দে ফেরা জীবন!

‘ লং আইল্যান্ড সিটি’তে এসে পৌঁছেছি আমরা। নদীর কিনার ঘেঁষে মনোরম এক স্থান। এক জীবনের বাকি বিকেলগুলো নির্দ্বিধায় কাটিয়ে দিতে আপত্তি নেই এইখানে। বিকাল আর সন্ধ্যার সন্ধিক্ষণে নদীতীরের এই স্থানে দাঁড়িয়ে অস্তমিত সূর্য দেখলে কেবলই আমার শহর চাঁদপুরের নদীতীরের সূর্যের অস্তাচলে যাবার সময়ের কথা মনে পড়ে। সন্তানের যেকোনও সাফল্যে বাবা-মায়েরা গর্বিত হয়ে অকারণ অজুহাতে সকলকে বলতে ভালোবাসেন। তেমনি চিরকাল চেনা-অচেনা সকলকে কারণে-অকারণে গর্বে বুক ফুলিয়ে উচ্চস্বরে বলতে ভালোবাসি, ‘ আমার শহরের পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থলের নিকটবর্তী এইস্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্য।’

ড্যাডি... ড্যাডি... আওয়াজ কানে আসতেই পিছনে ফিরে তাকাই। শ্বেতাঙ্গ পিতা-কন্যা বল ছুঁড়ছে একে অপরকে। অনেকেই সন্তানদের নিয়ে খেলায় মগ্ন বিশালাকার মাঠে। কেউ পোষা কুকুর নিয়ে হেঁটে যায় আপনমনে। অদূরে কেউবা ব্যায়াম করছে হেডফোন কানে গুঁজে। মিউজিক বাজছে নিশ্চয়। অনেক মানুষের কোলাহল! প্রায় সকলেরই মুখে মাস্ক। সকলে দূরত্ব বজায় রাখছে। মানুষ বাইরে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। চমৎকার আবহাওয়ার এই দিনে কেউ বাইরে আসবে না, তা কী করে হয়! মনে পড়ে গেল আজ ভোরে ঘুম ভেঙে নিউইয়র্ক সিটি থেকে প্রথম ক্ষুদে বার্তা পেয়েছিলাম ... ‘ Nice weather is here but remember: if you go out, keep at least 6 feet of distance between yourself & others & wear a face covering.’

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/কালাম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর