৫ মে, ২০২০ ০৮:৫৭

স্বাধীনতা যুদ্ধ বনাম করোনা যুদ্ধ : আমাদের শিক্ষণীয়

তামিম আহমেদ চৌধুরী

স্বাধীনতা যুদ্ধ বনাম করোনা যুদ্ধ : আমাদের শিক্ষণীয়

তামিম আহমেদ চৌধুরী

স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাস কিছু চাটুকার, রাজাকার ও কাপুরুষ ছাড়া অন্যদের ছিল না কোন রেগুলার অফিস, ছিল না কোন বড় জমজমাট ব্যবসা, ছাত্রদের ছিল না কোন স্কুল-কলেজে যাবার তাড়া বা কোন পরীক্ষার চিন্তা, ছিল না কোন শপিংমলে ঘোরাঘুরি বা ঈদের শপিং। ছিল না কোন সত্যিকার অর্থের ঈদ। আমরা খেয়ে না খেয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে বেড়িয়েছি। শুধু চিন্তা ছিল দেশ স্বাধীন করা আর পাকহানাদের কাছ থেকে ইজ্জত সন্মান সহ প্রাণে বেঁচে থাকা।

তখনও কোন দুর্ভিক্ষ হয়নি বা না খেয়ে মানুষ মারা যায়নি কারণ সবাই একে অপরকে সাহায্য করেছে। দু’বেলা খাবার ছাড়া মানুষের অন্য কোন চাহিদা ছিল না। মানুষ ছিল অনেক মানবিক এবং পরস্পরের জন্য করেছে অসম্ভব ত্যাগ স্বীকার। যা আমাদের আজ খুবই প্রয়োজন।

হ্যাঁ আমরা পেরেছি। মহান নেতার ডাকে জীবন বাজি রেখে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। আমরা এখন পদ্মার মত নদীতে বিশ্বের চোখ রাঙ্গানী উপেক্ষা করে ব্রীজ নির্মাণ করছি। আজ আমাদের অর্থনীতি অনেকের জন্য ঈর্ষণীয়। কাজেই করোনাকেও আমরা সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে জয় করতে পারবো। আমরা পরীক্ষিত এক সাহসী জাতি।

কিন্তু কিছু লোকের অতি উৎসাহী চিন্তা আমাদেরকে বিপদে ফেলতে পারে। তারা আমাদের অর্থনীতি একেবারে ভেংগে পরড়ে ইত্যাদি বলে বলে বিচলিত করে ফেলছে বলে মনে হয়। আসলে আরো দুই মাস ব্যবসা, কলকারখানা, অফিস সীমিত আকারে চললেও সম্ভবত আমরা ভেংগে পরব না। কিছু ক্ষতিতো হবেই এবং তা বাস্তব। তবে করোনা আক্রান্ত হয়ে মহামারিতে অগনিত লোক মারা গেলে আমরা মানসিক ও অর্থনৈতিক সব দিক থেকেই চরম বিপদে পড়তে পারি।

মহামারি আর দুর্ভিক্ষ অবস্থা তৈরি হলে এটা কারও জন্যই সুখকর হবে না। কাজেই আমাদের প্রধান কাজ হবে মহামারি ঠেকিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা, কৃষক আর কৃষি উৎপাদনে সুরক্ষা দেয়া, আর দরিদ্র - নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সাহায্যের ব্যবস্থা করা। এর জন্য আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা ও শিক্ষার আলোকে সাহসের সাথে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নিতে পারি:

১। আমাদের করোনা সিচুয়েশন কি ভালোর দিকে না খারাপের দিকে যাচ্ছে? নিশ্চিত ভাবেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। অন্তত মে মাস পর্যন্ত আমাদের নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। কাজেই আমাদের ছুটি বা লকডাউন অন্তত: ঈদ পর্যন্ত চলমান থাকা দরকার এবং সরকার বিচক্ষণতার সাথে সম্ভবত সে ভাবেই এগুচ্ছে। ঈদের আগে কোন ভাবেই ছুটি বা লকডাউন তুলে না নেয়া এবং গণপরিবহন, ট্রেন, প্লেন ও লঞ্চ চালু না করার জন্য সুপারিশ করছি। আর মাত্র পনেরদিন পরে দেশব্যাপি এ ধরণের চলাচল মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির অবতারনা করতে পারে।
২। খবরে শুনতে পাচ্ছি আগামী ১০ মে থেকে দেশব্যাপি সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত সব দোকানপাট ও শপিংমল খোলা থাকবে। এ সিদ্ধান্তে সচেতন অধিকাংশ মানুষই হতাশ। দেশে চলছে ছুটি বা লকডাউন, সকল শহর ও গণপরিবহন বন্ধ, পারাইভেট যানবাহন বন্ধ , অধিকাংশ ড্রাইভার ছুটিতে, সকল মসজিদ/ উপাসনালয় একপ্রকার বন্ধ, ঈদের জামাত আর মাত্র ১৯/২০ দিন পরে হবে কিনা সন্দেহ, গণপরিবহন বন্ধ তাই ঢাকার বাহিরের দোকান শ্রমিকরা কি ভাবে আসবে? বাংলাদেশের প্রক্ষিতে ঈদের আগে দোকানে/ শপিংমলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হবে কি ভাবে? হাজার হাজার লোকের ঘরের বাহিরে ইফতারী করার ফল কি হবে?

৩। দেশ যখন করোনা যুদ্ধে ব্যস্ত, শতশত ডাক্তার, সরকারি কর্মকতা- কর্মচারী সেনাবাহিনী, পুলিশ ইত্যাদি দেশ প্রেমিক সদস্যগন যখন জীবন বাজিরেখে পরিবার থেকে দূরে কাজ করছে, কোটি লোককে ত্রাণ দেবার অক্লান্ত চেষ্টা করা হচ্ছে তখন কিসের ঈদ? কিসের ঈদের শপিং? এই সিদ্ধান্ত পুনবিবেচনা করার আহবান জানাচ্ছি।

৪। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের কোন শপিং ছিল না এবং ঈদও ছিল সাদামাটা। এই করোনা যুদ্ধে এটাই আমাদের শিক্ষণীয়। বেঁচে থাকলে সবই হবে। দোকান মালিকরা স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় একটু sacrifice করতে পারে এবং এবার লাভ না করে নিজ থেকে কর্মচারীদের বেতন দিতে পারে এবং প্রয়োজনে সরকারের সহায়তা নিতে পারে। আসুন সকল করোনা আক্রান্ত পরিবারের সাথে একাত্ম হয়ে বলি এ বছর কোন Eid Celebrations নয়।

৫। সরকারি প্রশাসন, দলীয় নেতাকর্মী, প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহায়তায় Garments Workers, দরিদ্র ও অসহায় মানুষের দেশব্যাপী তালিকা করে ১/২ মাস সহায়তা নিশ্চিত করা যেতে পারে। সরকার এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে।

৬। ১/২ মাস কৃষক ও কৃষিপণ্যের প্রয়োজনীয় সহায়তা, উৎপাদন, সংগ্রহ/ মজুত ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহায়তা নেয়া যেতে পারে। খাদ্য উৎপাদন, সংগ্রহ, সরবরাহ ও যথাযথ কৃষকের মূল্য নিশ্চিত করতে পারলে আমাদের কোন দুর্ভিক্ষ হবে না।

৭। আমাদের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান এর মালিকগণ লোকসান হবে বলে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে সরকারের সাথে দেনদরবার করছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তা যৌক্তিক বটে। তবে আমাদের দেখার বিষয় স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এই করোনা যুদ্ধে বড় বড় ব্যবসায়ীগণন নিজ লোকসান সামলানোর জন্য নিজের সম্পদ থেকে কতটুকু sacrifice করেছেন! ২০/৩০ বছর পরেও সরকারের উপর তাদের এতো নির্ভরতা কেনো? নিজেদেরতো কিছু Risk management capability থাকা বাঞ্ছনীয় বৈকি! কাজেই এই ২/৩ মাস মালিকদের কর্তৃক শ্রমিকদের সহায়তা দিতে হবে এবং এটা সরকারের পাশাপাশি বড় বড় ব্যবসায়ীগণের নৈতিক দায়িত্ব।

৮।পরিশেষে আবারও বলবো দয়া করে লকডাউন বা ছুটি ঈদ পর্যন্ত কঠোরভাবে প্রয়োগ করুন। ১০ মে থেকে দেশব্যাপি সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত সব দোকানপাট ও শপিংমল খোলা রাখার সিদ্ধান্ত পুনবিবেচনা করুন। আমাদের সামাজিক সচেতনতা বোধ খুবই সীমিত এবং পুলিশ -র‌্যাব, সেনাবাহিনী দিয়েও আম জনতার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যায়নি। সুতরাং এ সিদ্ধান্ত আমাদেরকে ভয়াভহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। কাজেই দোকানপাট ও শপিংমল খোলার সিদ্ধান্তটি পরিস্থিতি বুঝে আমরা ঈদের পরে নিতে পারি। আশাকরি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের শিক্ষা এই করোনা যুদ্ধ মোকাবেলায় আমাদেরকে আরো ত্যাগী, সহনীয় ও সাহসী করবে। ধন্যবাদ।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর