১০ মে, ২০২০ ২০:৩৮

আমার অক্ষরজ্ঞানহীন মা-ই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক

আমিনুল ইসলাম

আমার অক্ষরজ্ঞানহীন মা-ই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক

আমিনুল ইসলাম

অন্যদের চাইতে একটু অন্য রকম হওয়ার কারণে স্কুলে আমাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করতো। লেখাপড়া কিছুই তেমন বুঝে উঠতে পারতাম না। আমার বড় বোন আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতো। ছেলেদের স্কুল হওয়াতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আমার ক্লাস নোট, বাড়ির কাজ সব আমার বোনই লিখে নিয়ে আসতো। আমার পক্ষে সেসব বুঝা কঠিনই ছিল।

এক সময় লেখাপড়া করতে পারব কিংবা স্কুলে যেতে পারব কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিলো। আমরা মানুষরা ঈদে কার চাইতে কে কতো বেশি ব্যতিক্রম পোশাক পরবো; কার আউট লুক কতো ব্যতিক্রম হলে ভালো হয় এই নিয়ে কতো কিছুই না করে বেড়াই। অথচ একটা মানুষ যদি স্বাভাবিকের চাইতে একটু অন্য রকম হয়; তাহলে আমরা তাকে গ্রহণ করতে চাই না। তাকে স্কুল থেকে বের করে দিতে চাই। নইলে যে অন্য ছেলে-মেয়েরা ব্যতিক্রম হয়ে যেতে পারে! তাকে বন্ধু-বান্ধবরা কেউ আপন মনে করে না। তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে।

আমার ক্ষেত্রে এই সবই হয়েছে। আমাকে পাড়ি দিতে হয়েছে এক মহাসমুদ্র। এই মহাসমুদ্র আমি একা পাড়ি দেয়নি। আমার মা; লেখাপড়া না জানা অক্ষরজ্ঞানহীন মা ঘোষণা করলেন- যে যাই বলুক আমি আমার সন্তানকে স্কুলে পাঠাবোই। নইলে আমার এই সন্তান তো আজীবন পরিবার এবং সমাজের বোঝা হয়ে থাকবে।

স্কুলে যাওয়া যার বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো- তাকে মা এক রকম সকল বাঁধা অতিক্রম করে স্কুলে পাঠিয়েছেন। সঙ্গে হয় নিজে যেতেন, না হলে তার কন্যাদের পাঠাতেন।এরপরও এতো সহজ ছিল না পথচলা। সামান্য শব্দ শুনলেও ভয় পেতাম। খুব সহজ কিছুও একদম বুঝতে পারতাম না। রাস্তার পাশ দিয়ে ট্রেন চলে গেলে ভয়ে আঁতকে উঠতাম। সেই দৃশ্য দেখে ক্লাসের বন্ধুরা হাসাহাসি করতো।

আমি বাসায় এসে মন খারাপ করে বসে থাকতাম। মা বলত- ওরা যাই করুক। তুমি ওদের ঘৃণা করবে না। তুমি ওদের সাথে সব সময় হেসে কথা বলবে। দেখবে একটা সময় ওরাও তোমাকে ভালবাসবে। আমি সেটা মেনে চলেছি জীবনভর। মনে আছে ঢাকা ছেড়ে যখন সিলেটের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম, আমার বাবা বলেছিল- ওর ঢাকার বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের সাথে থেকেই পড়াশুনা করুক।

আমার মা বলেছিলেন- ওর যেখানে পড়তে ইচ্ছা হয়, ও সেখানেই যাবে। ওর তো পড়াশুনাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো, তখন তো কেউ কিছু বলেনি। এখন সে তার ইচ্ছা মতো পড়বে। সিলেটে গিয়ে কখনো কখনো মাঝ রাতে ভয়ে ঘুম ভেঙে গেলে মাকে ফোন করতাম। তখন মোবাইল ফোন ছিল না। মাঝ রাতে ল্যান্ড ফোন ধরে একটুও বিরক্ত না হয়ে মা বলতেন
-কি, ভয় পেয়েছিস? এই তো আমি আছি পাশে।
এরপর আমি আবার ঘুমিয়ে যেতাম।

দেশের পড়াশুনা শেষ করে বিদেশে আসার সময়ও সবাই বলছিল- ওর বিদেশে গিয়ে কাজ নেই। অনেক পড়েছে। এখন সবার সাথে থাকুক। ও এতো কিছু পারবে না। আমার মা বললেন- ও যদি যেতে চায়, তাহলে যাক।

আমার মনে আছে মা সেবার বলেছিলেন- সবাই মানুষ। তুমি সবাইকে এক ভাবে দেখবে। কখনো কারো সাথে খারাপ আচরণ করবে না। কখনো কোন মানুষকে ভিন্নভাবে দেখবে না। কখনো কাউকে ঘৃণা করবে না। দেখবে, তুমি যদি সবার সাথে হাসিখুশি থাকো, কাউকে ঘৃণা না করো; তোমার নানা অপূর্ণতা থাকার পরও মানুষ তোমাকে ভালবাসবে। আমি এটাও অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি।

আমার একদম কাছের মানুষ না হলে; কেউ কোন দিন বলতে পারবে না, আমি কারো সাথে সামান্য জোর গলায় কথা বলেছি। এমনকি আমার যদি কোন শত্রুও থেকে থাকে, আমি তাকেও কোন দিন ঘৃণা করতে যাবো না। উল্টো তার সঙ্গে হাসি মাখা মুখেই কথা বলবো। জীবনের চলতি পথে স্রেফ অন্যদের চাইতে খানিক আলাদা হবার কারণে আমাকে যেই ঘৃণা নিয়ে পথ চলতে হয়েছে; আমি কোন দিন চাইনি কোন মানুষ সেই ঘৃণা অন্তত আমার কাছ থেকে পাক।

বাসার কাজের মানুষ হোক, শ্রমিক কিংবা বুদ্ধিজীবী হোক; আমি আজীবন সবাইকে একইভাবে দেখে এসছি। কারণ আমার কাছে- সবাই আমরা মানুষ।

আমার বাবা যে বছর মারা গেলেন; আমার মা তখন ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য আমার কাছে এই বিদেশে। মাকে বাবার মৃত্যু সংবাদ দেয়ার দায়িত্ব পড়লো আমার কাছে। আমি কোনভাবেই বুঝতে পারছিলাম না, কি করে এই সংবাদ দিব। আমার বাবা এবং মার ভালোবাসা এতোটাই প্রবল ছিল যে তারা এক জীবনে কখনো আলাদা থাকেনি। আমার মনে আছে সুইডেনে থাকতে আমি মাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য মার রেসিডেন্স পারমিটও করেছিলাম। কিন্তু মা গেলেন না। মার যুক্তি হচ্ছে- তোর বাবার শরীর খারাপ, সে তো যেতে পারবে না। তাই আমিও যাবো না।

সেই মাকে যখন চিকিৎসার জন্য বাধ্য হয়ে বিদেশে আসতে হলো; বাবা চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। আমি কোন ভাবেই বুঝতে পারছিলাম না, কি করে মাকে বলবো। কারণ মার শরীরও খারাপ। ক্যান্সারের চিকিৎসার ধকল তিনিও আর নিতে পারছিলেন না। আমি বিদেশের মাটিতে এক হাতে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি, ক্লাস-পরীক্ষা নিচ্ছি, মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি; মার দেখভাল করছি। বাবা যে মারা গিয়েছে; একটু যে মন খারাপ করে বসে থাকবো সেই উপায় নেই।

সপ্তাহ খানেক পর এক সন্ধ্যায় মা'কে বললাম
-মা, বাবা তো আর নেই।

মা শুনলেন। এরপর বললেন- তুমি একদম মন খারাপ করবে না। কারো বাবা-মাই আজীবন বেঁচে থাকে না। তোমার বাবার বয়স হয়েছিলো। তাকে তো যেতেই হতো। সে সফল জীবন কাটিয়ে গিয়েছে। তার ছেলে-মেয়েরা দেশের নামকরা স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। মানুষ হয়েছে। সে সফল বাবা ছিল। তুমি একদম মন খারাপ করবে না।

আমি খুব অবাক হলাম, আমার মা নিজে কষ্ট পাওয়ার বদলে কিনা ভাবছে- আমার কষ্ট হবে; তাই তিনি দিব্যি নিজের কষ্টটা লুকিয়ে ফেললেন। সেই রাতে আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম- মা-পুত্র আমরা দুজনেই দুজনের চোখের পানি একে অন্যের কাছে আড়াল করার চেষ্টা করছি। চিকিৎসা শেষে মা যখন দেশে ফিরছিলেন, যাবার সময় তিনি বললেন
-তুই একই সাথে আমার ছেলে এবং মেয়ে। আমার মনে হয় না আমার আর কোন সন্তান আমাকে এভাবে দেখভাল করতে পারত।
আমি জানি না, আমার মা কেন এই কথা বলে গিয়েছিলেন। এটাই ছিল সরাসরি মার সাথে বলা আমার শেষ কথা।
এরপরও বেশ কিছু দিন কথা হয়েছে টেলিফোনে।
মা সব সময় বলতেন- আমার ছোট সন্তান যাকে সবাই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিল; সেই এখন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
আমি জানি এই মাথা তুলে দাঁড়াতে কতোটা কঠিন পথ আমাকে পাড়ি দিতে হয়েছে। যেই পথ আমি আজও পাড়ি দিয়ে চলেছি।
এখনও জীবনের এই পর্যায়ে এসেও আমাকে আমার যুদ্ধ জারি রাখতে হয়েছে।

বছর দুয়েক আগে এই সময়টাতেই পর্তুগালে গিয়েছি সেখানকার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে। সেই গ্রীষ্মে আমার মন বেশ খারাপ ছিল নিজের ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া নানা সব ঘটনা জন্য। হঠাৎ একদিন শুনতে পেলাম- মার শরীর খুব খারাপ হয়েছে। কথা বলার মতো অবস্থাতেই নেই। মাকে ফোন করলাম মা বললেন
-কেমন আছিস টুটুল (আমার ডাক নাম)?
-আমি ভালো আছি। এখন কেমন লাগছে তোমার মা?

আমার মা বললেন
-তোর গলা শুনে তো মনে হচ্ছে না তুই ভালো আছিস। তোর মন ভালো তো? ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করেছিস তো?
-মা, তুমি তোমার এই শরীরেও আমার কথা চিন্তা করছ?

এই ছিল মার সাথে বলা আমার শেষ কথা।
পরের দিন জানতে পেরেছি মা চলে গিয়েছেন পৃথিবী ছেড়ে। জীবন নামক যুদ্ধে ছয় ছেলে-মেয়েকে মানুষ করা আমার মা ক্যান্সার নামক রোগের কাছে হার মানলেন।

আমার পুরো পৃথিবী বদলে গেল মুহূর্তে। এখন আর মাঝ রাতে ভয় পেয়ে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে কেউ বলে না- কি ভয় পেয়েছিস? এইতো আমি আছি। এখন আর মন খারাপ থাকলে কেউ বলে না- কিরে তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে না ভালো আছিস! এখন আর মন-প্রাণ খুলে কারো সাথে গল্প করা হয় না মা।

আমার জীবনে যত যা অর্জন; সেটা সম্ভব হয়েছে আমার মায়ের জন্য। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে মানবিক হতে হয়। কিভাবে মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হয়। এসব কিছু শেখাতে আমার মাকে পিএচডি ডিগ্রি নিতে হয়নি। স্কুলেও যেতে হয়নি। আমার অক্ষরজ্ঞানহীন মা-ই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। সব কিছু এখানেই আছে। তবুও মনে হয়- কিছু নেই আমার পাশে।

বিডি-প্রতিদিন/শফিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর