গত কয়েকদিনে ৭টি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স তথা গৃহস্থালি হিংস্রতার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। করোনার এই প্রাদুর্ভাবের সময় যেখানে সচেতন মানুষ নিজের জীবন নিয়ে শংকিত, সেখানে কিছু মানুষ নিজের জাত চেনাতে বিন্দু পরিমাণ দ্বিধা করছেন না! ৭টি অভিযোগের সবকটিই স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রহার করা সম্পর্কিত এবং তারা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত স্বামী!
অনেকেই যুক্তি দিতে চাইবেন, এই সময়ে হয়তো মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা খারাপ হচ্ছে! জ্বি হ্যা, বুঝতে পারছি মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা খারাপ। তবে জানতে চাওয়া প্রয়োজন,এটা কেমন মানসিক অস্থিরতা যার সমাধান শুধু স্ত্রীকে প্রহার করেই আসে? মাফ করবেন, যেসব ভদ্রমহোদয়গণ স্ত্রীদের পেটান তাদের কাছে এটি আসলে নতুন কিছু নয়। করোনা তাদের এমন করেনি বরং তারা পূর্ব থেকেই মানসিকভাবে এমন!
এই শ্রেনিভুক্ত ভদ্দরনোকেরা বাইরে সক্ষমতা দেখান, খেটে খাওয়া দিন মজুর ও শ্রমিক সম্প্রদায়ের উপর আর ঘরে এসে দেখান বৈবাহিক সূত্রে অধিকার পাওয়া বউয়ের উপর। আরে ভাই, ভাল না লাগলে, মতাদর্শে না মিললে এ্যামিকেবল সেটেলমেন্ট তথা সৌহার্দপূর্ণ সমঝোতায় চলে যান! এরকম পারিবারিক হিংস্রতা তো নিজেদের জীবন বিষিয়ে তোলার পাশাপাশি সন্তানদের ভবিষ্যৎও অন্ধকারে ঠেলে দেয়।যদিও নারী নির্যাতন মামলার বিষয়গুলো সবসময়ই সঠিকতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, তথাপি নারী নির্যাতনের হার কিন্তু কম নয়। যারা পুরুষের উপর নির্যাতনের কথা বলতে চাইবেন, দয়া করে আপাতত একটু সাইডে থাকুন। আনুপাতিক হার বিবেচনায় আনলে পুরুষ নির্যাতনের হার নারী নির্যাতনের তুলনায় নগন্য হবে। আইনের স্পিরিট হলো অন্যায়ের শিকার যেই হোন না কেন, আইনের দ্বারস্থ হওয়ার অধিকার তাঁর বা তাঁদের রয়েছে।
প্রায় প্রতিদিনের মত গতকালও ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স এর আরও একটি ঘটনায় পুলিশকে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেই হলো। ভিকটিম নিজে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাহায্য চাইলেন তখন সেটি আমাদের দায় ও দায়িত্বের মধ্যে চলে আসে। ধরে নেই ভিকটিমের নাম সুমা। তিনি নিজে খুব গোপনে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছেন। নিজের ও নিজের সন্তানের জীবন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে সুন্দরভাবে বার্তা পাঠান। নিজের বাসার ঠিকানা চাইলে তিনি মুহূর্তেই তা পাঠিয়ে দেন। ঠিকানা পাওয়ার সাথে সাথেই ওয়ারী বিভাগের ডিসি স্যারকে অবহিত করে, ওয়ারী থানার ইনস্পেকটর তদন্তকে বললাম আমাদের একজন স্মার্ট অফিসারকে যোগাযোগ করতে বলুন।
তিনি বললেন, 'স্যার এস.আই তামান্না ইজ গুড'! ভাল লাগলো এই ভেবে যে, এক নারীর ত্রাতার ভূমিকায় যাবেন আরেক নারী। তামান্নাকে পুরো বিষয় ব্রিফ করে ভিকটিমের কাছে পাঠাতেই ভিকটিমের স্বামী আমার অফিসারের চাকরি প্রায় খেয়ে ফেলছিলেন। আইনগত প্রক্রিয়ায় কারো হুমকি যে আমরা গণনায় নেইনা সেটা ভদ্রলোক জানতেন না। ভিকটিমের অভিযোগ প্রাপ্তি থেকে শুরু করে তাঁর ও সন্তানের উদ্ধার প্রক্রিয়াতে আমাদের সময় ব্যয়িত হয়েছে মাত্র ১৫ মিনিট!
যথাযথ আইনগত বিষয়ে চাহিবামাত্রই সেবা দিতে ওয়ারী বিভাগ বদ্ধপরিকর।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, ভিকটিম শিক্ষিতা ও স্মার্ট ছিলেন, তাই আমাদেরও কাজ করতে কষ্ট কম হয়েছে। এরকম সমস্যার মুখোমুখি প্রায়শই অনেকেই হচ্ছেন এবং সেখানে শিক্ষিত, অশিক্ষিত সব ধরণের মানুষই রয়েছেন। বর্তমানে মোবাইল আমরা সকলে ব্যবহার করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকলে এখনো অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। তাই কয়েকটি কাজ আমাদের নারীদের অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। শুধুমাত্র পারিবারিক হিংস্রতা থেকে বাঁচার জন্য নয়, যে কোনো প্রয়োজনেই আপনাদের উচিত নিকটস্থ থানার অফিসার ইনচার্জ ও ডিউটি অফিসারের নাম্বার সংরক্ষণ করা। পাশাপাশি সার্কেল এএসপি অথবা জোনাল এসি থেকে ধরে ঊর্ধ্বতন অফিসারদের নাম্বার সংরক্ষণ করতে পারেন। এতে প্রয়োজনে যেকোনো সময় আপনি সাহায্য চাইতে পারবেন। এছাড়া ৯৯৯-সহ অন্যান্য জরুরি সেবা তো রয়েছেই!
কয়েক সপ্তাহ আগে এক নারী ভিকটিম নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর ফেসবুকে গোপনে মেসেজ করে বলছিলেন, 'আমার স্বামী আমাকে মোবাইল ধরতে দিচ্ছে না, দিলেও সারাক্ষণ নজরদারিতে রাখছেন' তাকে বলেছিলাম যে কোনভাবে বাসার ঠিকানা পাঠাতেই হবে। তাকে আরও বলেছিলাম ওয়াশরুমে যেয়ে বালতিতে পানি ছেড়ে দিন, এতে কথা বলার শব্দ বাইরে আসবে না! তিনিও আমাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পেরেছিলেন। এই ছোট্ট ছোট্ট কৌশলগুলো মাথায় রাখলে অনেক বিপদ থেকে নিজেকে সুরক্ষা দেয়া সম্ভব।
ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স যারা করছেন, তাঁদের জন্য বার্তা হলো নিজেকে আর অক্ষম করে উপস্থাপন করেন না! ঘরে, বাইরে সব জায়গায় যদি অক্ষমের মতই আচরণ করেন তাহলে আর নিজেকে মানুষ বলে দাবী করবেন কোন যুক্তিতে? দ্বন্দ্ব, ঝগড়া নেই এমন কোনো পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না, তাই বলে মারধর করাটা প্রকৃত পুরুষের কাজ কখনোই হতে পারে না। শুধু মাথায় রাখুন আপনার সামনে আপনার বোনকে কেউ মারধর করলে আপনার নিশ্চয়ই ভাল লাগবে না, আপনার স্ত্রীও কারো না কারো বোন। শুধুমাত্র আমরা পুরুষরা চাইলেই ডমেস্টিক ভায়োলেন্সকে কমিয়ে আনতে পারি!
যদিও শূন্যের কোটায় কখনোই আনা যাবে না,এটি অলীক চাওয়া হবে তা আমরা সবাই জানি। এর বাইরেও একটি অংশ থাকে যেখানে নারী নিজেই অন্যায় করেন বারবার। পুরুষ নির্যাতন করে তাঁর মানসিক অবস্থাকে ভঙ্গুর করে তোলেন- এটিও আমাদের সমাজেরই ছবি! তবে মোট সংখ্যায় এই হার খুবই নগন্য!
আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কিছু পুরুষ স্ত্রীকে প্রহার করতে পারার মাঝে এক ধরণের অহংবোধের ছোঁয়া পান। কষ্ট তখন বেশি হয় যখন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত পুরুষগণ এরুপ আচরণ করেন এবং তার অপরাধ প্রমাণিতও হয়।
আসুন ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স মুক্ত সমাজ গড়ি এবং সকলকে নিজেদের প্রার্থনায় রাখি।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/কালাম