১৪ জুন, ২০২০ ১১:৪২

মোহাম্মদ নাসিম-একজন কর্মীবান্ধব নেতার মহাপ্রয়াণ

অধ্যক্ষ মোঃ শাহজাহান আলম সাজু

মোহাম্মদ নাসিম-একজন কর্মীবান্ধব নেতার মহাপ্রয়াণ

মোহাম্মদ নাসিম ও শাহজাহান আলম সাজু

মোহাম্মদ নাসিম শুধুমাত্র একটি নামই নয়, একটি প্রতিষ্ঠান। জাতির জনকের ঘনিষ্ঠ সহচর পিতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আলীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ছাত্র জীবন থেকেই তিনি ছাত্রলীগের মাধ্যমেই সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। তিনি অসম্ভব একজন কর্মীবান্ধব নেতা ছিলেন। কর্মীবান্ধব মোহাম্মদ নাসিম দলের যে কোন পর্যায়ের নেতা কর্মীরা যে কোন সমস্যা নিয়ে তার কাছে গেলে তিনি কাউকে বিমুখ করতেন না। আর কিছু না হোক অন্তত মনযোগ দিয়ে তার কথা শুনতেন। সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। বর্তমান রাজনীতিতে কর্মীদের সম্মান জানানো, গুরুত্ব দিয়ে তাদের অভাব অভিযোগ শুনার নেতার খুব অভাব। এ ক্ষেত্রে নাসিম ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম।

পচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী দুঃসময়ে নাসিম ভাইয়ের ভূমিকা চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। স্বৈরাচার বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে নাসিম ভাই অত্যন্ত দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করে গেছেন। শত দমনপীড়ন, গ্রেফতার, নির্যাতন ও ঝড়ঝাপ্টার মধ্যেও তিনি রাজপথের একজন অপরিহার্য নেতা ছিলেন। তিনি সবসময় রাজপথে কর্মীদের আগলে রেখেছেন। দলীয় নেতা-কর্মীদের সুখ দুঃখে তিনি সবসময় ঝাপিয়ে পড়তেন।

নাসিম ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ত্রিশ বছরেরও অধিককাল সময়ের। এ সময়ের মধ্যে তার সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। ১৯৯১ ইং সালে ঘটনা। এরশাদের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায়। আমি তখন ইবি ছাত্রলীগের সভাপতি। ছাত্রলীগের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্য স্থাপন করা অভ্যর্থনা ক্যাম্পে আমি বসা ছিলাম। আমি অন্য একটি কাজে যাবার উদ্দেশ্যে উঠে যাবার সময় পাবনা থেকে একজন শিক্ষার্থী নাসিম ভাইয়ের একটি চিঠি নিয়ে আসে। আমাকে উল্লেখ করে লেখা পত্রটিতে নাসিম ভাই ছেলেটিকে ভর্তির ব্যাপারে সবরকম সহায়তা করার জন্য আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। আমি তার ভর্তির ব্যাপারে সহায়তা করার জন্য ডিপার্টমেন্টে গিয়ে তার সব কাগজপত্র সংগ্রহ করার সময় কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের সংঘর্ষের জের ধরে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র উচিয়ে আমাকে ম্যাটস ক্যাম্পাস থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তারা প্রথমে আমাকে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে এবং পরবর্তীতে কোর্টপাড়ায় একটি নির্জন পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে বুকে রাইফেল ঢেকিয়ে গুলি করে। গুলিটি মিস হয়। দ্বিতীয় গুলিটি করবার আগেই পুলিশ ব্লাংক ফায়ার করে আমাকে উদ্ধার করে। 

উল্লেখ্য, আমাকে অপহরণের ঘটনাটি মুহূর্তে সমগ্র কুষ্টিয়ার ছড়িয়ে পড়ে এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র আনোয়ার আলী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে অবগত করেন। নেত্রী আমাকে উদ্ধারের জন্য আনোয়ার আলীকে কঠিন ভাষায় নির্দেশ দেন এবং আইজি ও স্বরাষ্ট্র সচিবকে কড়া নির্দেশ প্রদান করেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা তখন জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী ছিলেন। এই ঘটনার পর থেকে নাসিম ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে নাসিম ভাই ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে আমি তার কাছে আমার বাসায় একটি টিএন্ড টির ফোন বরাদ্দের জন্য একটি আবেদন নিয়ে  স্বাক্ষাৎ করি। তিনি তাৎক্ষণিক তার এপিএসকে ডেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংযোগের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেন। শুধু তাই নয়, ফোনের সংযোগ পেয়ে আমি যেন নাসিম ভাইয়ের সাথে ফোনটি দিয়ে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত করি সেটাও এপিএস সাহেবকে বলে দেন। সেই সময় টিএন্ডটির ফোনের বরাদ্দ পাওয়া অনেক কঠিন ব্যাপার ছিল। নাসিম ভাইয়ের নির্দেশ অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আমার বাসায় টিএন্ডটি ফোনের সংযোগ লেগেছিল।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ওমরাহ খান শিবিরের সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হলে তার শোক সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। আমি তখন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। কসবা ছাত্রলীগের সম্মেলনে কমিটি আমার হাতেই করেছিলাম এবং ওমরা সম্মেলনে সভাপতি হয়েছিল। সে খুব ভালো একজন সংগঠক এবং খুব জনপ্রিয় ছিল ছাত্রনেতা ছিল। শোকসভায় আমরা ঢাকা থেকে সড়কপথেই কসবা যাবার কথা ছিল। অনুষ্ঠানের আগের দিন আখাউড়া-কসবা এলাকার তখনকার এমপি এডভোকেট শাহআলম ভাই আমাকে ফোন করে জানালেন আগামীকাল নাসিম ভাই হেলিকপ্টারে আখাউড়া এবং কসবায় যাবেন। আমি যেন সকালে নাসিম ভাইয়ের বাসায় উপস্থিত থাকি। আমি বললাম, নাসিম ভাইয়ের সাথে তো আরও অনেকেই যাবেন, আমার কি হেলিকপ্টারে জায়গা হবে? শাহআলম ভাই বললেন এটা নাসিম ভাই বুঝবে। নাসিম ভাইই তোমার কথা বলেছেন। আমি মনে মনে ভাবলাম হেলিকপ্টারে তো অনেক সিনিয়র নেতারা যেতে চাইবেন। আমি গিয়ে যদি আবার হেলিকপ্টারে সিট না পেয়ে ফিরে আসতে হয় কেমন দেখাবে। এমন সময় নাসিম ভাইয়ের এপিএস আমাদেরই বন্ধু নব আমাকে ফোন করে জানায় নাসিম ভাই আগামীকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবেন আপনাকে সাথে যেতে বলেছেন। নবো বলল নাসিম ভাই পুরনো এয়ারপোর্ট থেকে হেলিকপ্টারে যাবেন। আমি বললাম, অনেক সিনিয়র নেতারা থাকবেন হেলিকপ্টারে আমার জায়গা হবে তে? নবো বলল নাসিম ভাইই আপনার কথা বলেছেন, ছাত্রলীগের প্রোগাম সাজু কেন্দ্রিয় যুগ্ম- সম্পাদক তার এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রোগ্রাম সাজুকে আমার সাথে যেতে বল।

পরদিন হেয়ার রোডে নাসিম ভাইয়ের বাসা থেকে পুরনো এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখি আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু, স্বরাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি আমাদের নাসির নগরের এমপি সাইদ ভাই (প্রয়াত মৎস্য মন্ত্রী), ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলাম এমপি (সাবেক প্রতিমন্ত্রী) সহ বেশ কয়েকজন এমপি আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। হেলিকপ্টারে আসনের চেয়ে লোক বেশি। এ অবস্থায় আমি নিজেও বিব্রত বোধ করি। আমাকে অবাক করে নাসিম ভাই বললেন, "ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম, এখানে মুল নেতা সাজু, তুমি আগে আগে উঠে সিট দখল কর"। একে একে তিনি সাইদ ভাই, খসরু ভাই, বিটিভির ক্যামেরাম্যান সবাইকে উঠতে বললেন হেলিকপ্টার আসন শেষ হয়ে যাওয়ায় সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন এমপিসহ অনেকেই সাথে নিতে না পেরে তাদেরকে বুঝিয়ে হাসি মুখে বিদায় করে দিয়েছিলেন নাসিম ভাই। আমি নাসিম ভাইয়ের এই আচরণ দেখে শুধু মুগ্ধই হয়নি রীতিমতো অবাক হয়েছিলাম। আমাকে এতটা গুরুত্ব না দিলেও পারতেন। সেইদিন থেকে নাসিম ভাইয়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল।

করোনার সংক্রমণের কিছুদিন আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তনের ১৪ দলের উদ্যোগে শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী,সংস্কৃতিসেবিসহ পেশাজীবিদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সমাবেশে আমি স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের পক্ষ থেকে লোকজন নিয়ে অংশগ্রহণ করি। সমাবেশে বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠনের অনেক নেতা উপস্থিত ছিলেন। সবাই বক্তৃতা করছেন। আমার অন্য আরেকটি প্রোগ্রাম থাকায় আমি এখানে প্রোগ্রাম শেষ না করেই নাসিম ভাইকে না বলে চলে আসি। নাসিম ভাই আমাকে খুঁজে না পেয়ে মনে করেছেন আমাকে বক্তৃতা করার সুযোগ না দেওয়ায় আমি রাগ করে চলে এসেছি। নাসিম ভাই রাতে আমাকে ফোন করে বললেন, তুমি না বলে চলে গেলে? তুমি কি রাগ করেছো নাকি। আমি বললাম নাসিম ভাই আমার অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রাম ছিল তাই চলে এসেছিলাম। নাসিম ভাই বললেন, প্রথমে আমার মনে ছিল না। পরে আমি তোমাকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য খুঁজছিলাম। এভাবে দলের সকল নেতা কর্মীদের নাসিম ভাই সম্মান দিতেন যা এসময়ে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না।

নাসিম ভাইয়ের সাথে সর্বশেষ আমার কথা হয় গত ১০ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের আলোচনা সভায়। ৭ মার্চ করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর ১০ তারিখের অনুষ্ঠান নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। নাসিম ভাই জানালেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর প্রোগ্রাম যত কষ্টই হোক তিনি আসবেন। অনুষ্ঠানে তিনি এসেছিলেন। করোনা সংক্রমণের পর এটাই ছিল নাসিম ভাইয়ের সর্বশেষ রাজনৈতিক প্রোগ্রাম। সেদিন মঞ্চে বসে নাসিম ভাইয়ের সাথে আমার অনেক কথা হয়েছিল। তিনি মুজিব জন্মশতবর্ষে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের গৃহীত বছর ব্যাপী কর্মসূচির ছাপানো প্রচার পত্রটি হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছিলেন। আমাদের বছরব্যাপী গঠনমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি দেখে তিনি অনেক খুশি হয়েছিলেন। তার বক্তৃতাতেও তিনি সেটা উল্লেখ করেছিলেন। করোনার শুরুতেই সেদিন তিনি যখন অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকছিলেন তখন অনেকেই তার সাথে হাত মিলাতে এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি হাসি মুখে মুখে বললেন করোনায় হাত মিলাতে হয় না। তিনি সেদিন শুধু আমার সাথে হাত মিলিয়ে বলেছিলেন, আপনাদের সবার পক্ষ থেকে আপনাদের নেতার সাথে হাত মিলালাম। এটাই নাসিম ভাইয়ের সাথে সর্বশেষ হাত মিলানো। আর কোনদিন এই সুযোগ আসবে না।

নাসিম ভাই আর কোনদিন মায়াভরা কণ্ঠে সাজু বলে ডাক দিবেন না। দলীয় নেতা-কর্মীরা আর কোনদিন নাসিম ভাইয়ের বুক উজাড় করা ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন না। জননেতা, কর্মীবান্ধব নাসিম ভাইয়ের মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে শুন্যতার সৃষ্টি হলো তা কোনদিন পূরণ হবার নয়। ওপারে সুখে থাকুন, নাসিম ভাই।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর