১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১০:৫৭

আমার দেখা ওয়ান ইলেভেন; রাজবন্দীদের নিয়ে কিছু স্মৃতি (পর্ব-৬)

অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু

আমার দেখা ওয়ান ইলেভেন; রাজবন্দীদের নিয়ে কিছু স্মৃতি (পর্ব-৬)

আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম ও ডা. জাহানারা আরজু

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগ তখন রাজনৈতিক বন্দীতে ভরপুর ছিল। আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলীল, প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধূরী, আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ, বিএনপি নেতা তারেক রহমান, প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকো, নাসিরুদ্দিন পিন্টু, আমান উল্লাহ আমান, ইকবাল হাসান টুকু, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা প্রমুখ। আর প্রিজন সেলে আমাদের ইউনিটে ভর্তি ছিলেন ব্যারিস্টার সিগমা হুদা। 

এছাড়াও অনেক নামকরা ব্যবসায়ী যেমন পারটেক্স গ্রুপের প্রয়াত এম এ হাসেম, যমুনা গ্রুপের প্রয়াত নুরুল ইসলাম বাবুল বন্দী রোগী ছিলেন। 

একদিন নাসিম বলল জাফরউল্লাহ ভাইকে মনে হয় হাসপাতাল হতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গত কয়দিন ধরে রিমান্ডে নিয়ে যা তা লিখাতে সাইন দিতে বলছে। আমি তো অবাক। বললাম, আমাদের স্টুডেন্টদের মধ্যে কেউ না কেউ প্রতিদিন ফলোআপ দিয়ে আসছে। উনি তো হাসপাতালেই আছেন। 
পরদিন প্রিজন সেলে নিজে গেলাম পত্রিকা নিয়ে। জাফরুল্লাহ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, “তোমরা তো দেখছই আমি এখানে হাসপাতালেই আছি। অথচ রিমান্ডে আমি বিভিন্ন বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছি বলে পত্রিকাতে মিথ্যে খবর ছাপানো হচ্ছে।’’

একবার সিগমা হুদা প্রিজন সেলে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। খবর পেয়ে অধ্যাপক মেশকাত স্যারসহ দৌড়ে গিয়ে দেখি ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেছে। 

আব্দুল জলীল ভাইয়ের শরীরে পেস মেকার, হৃদপিণ্ডের রক্তনালীত স্টেন্টিং (রিং) বসানো ছিল।

সবচেয়ে বেশি ভাল লাগত যখন প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন ভাইয়ের কাছে যেতাম। অফুরন্ত প্রাণ শক্তি ছিল মানুষটার মধ্যে। CCU তে থাকা অবস্থায় ডায়াবেটিস থাকা স্বত্বেও ইনসুলিন নিতেন না। বলতেন, ডাক্তার আমি পানির মধ্যে লতাপাতা মিশিয়ে খাই। দেখ খালি পেটে ব্লাড সুগারটা কন্ট্রোলে আছে। আর আমি বলতাম, শেকড় বাকড় খেলে আপনার কিডনি খারাপ হয়ে যাবে। পরে তাই হয়েছিল।

যাই হোক রমজান মাসে evening duty থাকলে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সাথে ইফতার করতাম প্রতিদিন। তখন তিনি উপরে কেবিনে চলে এসেছিলেন। তিনি নিজের হাতে বুট, পেঁয়াজু, মুড়ি সরিষার তেল দিয়ে মেখে দিতেন আর ডাক্তার, নার্স , পুলিশ, ওয়ার্ড বয় সবাইকে ডেকে ডেকে খাওয়াতেন। তাঁর আন্তরিকতার জন্যে অসম্ভব সুস্বাদু হত সেই খাবার। একদিন আমি বুট মাখাতে চাইলে বললেন ডাক্তারের হাতে spirit এর গন্ধ। ওয়ার্ড ভর্তি রোগী থাকত তখন কি করব? 

মহিউদ্দিন ভাই পরে যখনি কোথাও দেখা হত, তিনি দূর হতে বলতেন, “ওইতো আমার ডাক্তার। “ 

মহিউদ্দিন ভাই চলে যাওয়ার দিন আমাদের এক ওয়ার্ড বয়কে ১০,০০০ টাকা বকশিস দিলেন। বললাম, তুমি তো ভালই বকশিস পেলে। সে বলে ম্যাডাম, কেবিনে ভর্তি অমুক নেতার খবরের জন্যে, চিঠি আনা নেওয়ার জন্যে প্রতিদিন বিভিন্ন জনের কাছ থেকে এই পরিমাণ টাকা পেতাম। 

CCU তে ভর্তি প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকো সাহেবকে প্রায় প্রতিদিন বিকেলে তাঁর স্ত্রী বোরখা পরে দেখতে আসতেন। তখন কোকো সাহেব খুবই বিনয়ের সাথে আমাদের ডক্টরদের ডিউটি রুমে ঢোকার অনুমতি চাইতেন। আমরা দুজনকে প্রাইভেসির জন্যে ভেতরের ছোট রুমে বসতে দিতাম। তখন সেই রুম হতে সিগারেটের ধোঁয়া আসত। হৃদরোগীরা ধুমপান করলে আমরা কার্ডিওলজিস্টরা খুবই কষ্ট পাই। অধ্যাপক মেশকাত স্যারকে একদিন রিপোর্ট করি। 

আরেকদিন পারটেক্সের প্রয়াত হাসেম চাচা  আসলেন ভর্তি হতে। নাসিম কানাডা হতে ফোন করল। চাচা কিছুদিন আগে টিভিতে রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দেয়ার পর কোন অধ্যাপক তাঁকে ভর্তি নিতে রাজি ছিলেন না। তাই আমি চাচার কানে কানে বললাম, আপনার তো হার্টে বাইপাস করা। এখন শুধু বলেন বুকে ব্যথা। তাহলেই আমি CCU তে রাখতে পারব। ২ দিন অবজার্ভ করে কেবিনে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু চাচা কিছুতেই বলেন না বুকে ব্যথা। কারণ তাহলে আমরা নাকি কড়া ইনজেকশন দিয়ে দেব। তাঁকে শেষ পর্যন্ত ভর্তি করাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। 

শেষের দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভাই কেবিন ব্লকে ভর্তি হলেন। অন্য ডিপার্টমেন্টের তত্ত্বাবধানে থাকলেও খবর পেয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমাকে দেখে আঁৎকে উঠলেন। আলাউদ্দিন কেমন আছে জানতে চাইলেন। তখন আমি আমার পকেটে রাখা দুদকের তলব করা নতুন চিঠিটি দেখালাম। তো পাহারারত পুলিশের সামনে কাদের ভাইকে বললাম, দুদকে আর যাব না। তারা কয়েকটা মামলা করেছে আমাদের বিরুদ্ধে। হাইকোর্ট হতে জামিনও নিয়ে রেখেছি। 

চলবে...

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক : অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

 

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর