১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৩:৪৫

বইমেলা নিয়ে

পারমিতা হিম

বইমেলা নিয়ে

পারমিতা হিম

—আমি ঢাকায় আসি ২০০৮ সালে। এরপর থেকে ২০২১ বাদে মোট ১২ বছর প্রতিদিন বইমেলায় গেছি। ২০২১ এ কোভিডের ভয়ে যাওয়া হয় নাই। শুধু ভয় না, দীর্ঘদিন যাবার কারণে একটা ক্লান্তিও মনে হয় চলে আসছিল। সেই একই লোকজন, একই কথা, একই চটপটি আর হালিম— আমার আবার এক জিনিস বেশিদিন ভালো লাগে না— হয়তো এজন্যই আর যাই নাই। 

—বইমেলা পাঠকদের চেয়ে বেশি লেখক ও লেখক যশপ্রার্থীদের। পাঠকরা ঘরে বসে বা অন্য জায়গা থেকেই বই কিনতে পারে। কিন্তু পাঠকরা যারা একদিন লেখক হতে চায়, কেউ কেউ আছে লেখকপূজা করতে চায় তারা মেলায় যায়। এর বাইরে শিক্ষার্থীরা আছে, যারা সময় কাটাতে ও বই উল্টেপাল্টে দেখতে আসে। বাকিরা সকলেই হয় প্রকাশক, নয় লেখক, নয় লেখক যশপ্রার্থী। আমি মূলত এ প্রকাশক, লেখক ও লেখক যশপ্রার্থীদের সাথে কথা বলতে, সেলফি তুলতে, আড্ডা দিতে ও তাদের কাজকাম (ভংচং) দেখতে যেতাম।

—বইমেলা উপলক্ষে আমি সবসময়ই লোকের কাছে টাকা চাই। আমার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সঙ্গে সবসময় মেলায়ই দেখা হয়। উনারা সকলেই আমাকে বই কিনে দেন। দামি দামি বইগুলো আমি উনাদের কাছ থেকে গিফট নেই। আমি সময় টিভিতে কাজ করার সময় নিয়াজ ভাই এবং তুষার ভাইয়ের কাছ থেকে বই কেনার জন্য টাকা চেয়ে নিতাম—ফেব্রুয়ারি মাসের চাঁদা। কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক, নিয়াজ ভাইয়ের মত জনবিদিত কিপটাও আমাকে বছর বছর বইমেলার চাঁদা দিয়েছেন।

বিবিসিতে অবশ্য একমাত্র সাঈদা আপাকে বইমেলার চাঁদার ব্যাপারটা বোঝানো গেছিল। উনিও আমাকে বই কেনার জন্য মোটা অংকের চাঁদা দিছিলেন। 

—শুধু যে অন্যের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমি বই কিনতাম তা ঠিক না। আমি নিজে প্রচুর জুনিয়রদের বই কিনে দিতাম। এবং সেগুলো দামি বই। আমি স্টলে স্টলে সময় নিয়ে ঘুরতাম আর দেখতাম কমবয়েসী ছাত্রছাত্রীরা দামি বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে দীর্ঘনিঃশ্বাস নিচ্ছে। কেউ কেউ ৫০ টাকা কমে কিনতে চাইছে। এদেরকে আমি সবসময়ই বইগুলো কিনে দিয়েছি। প্রতি বইমেলাতেই এভাবে আমার তিন চারজনের সাথে পরিচয় হয় যাদের সঙ্গে পরের বছর আবার দেখা হয়। এবং তাদের সঙ্গে একটা সখ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয় যেটা আমি খুব উপভোগ করি। 

— আমি পরিচিত এবং নতুন লেখকদের বই কিনতাম। অনুরোধে না নিজে থেকেই। আমার যত বন্ধু বান্ধব, সখী ও সখা যত রকম অনলাইন বিজনেস, ক্রিয়েটিভ কাজ করে আমি আমার সাধ্যমতন তাদেরকে সাপোর্ট করার চেষ্টা করি। বলতে কোনো লজ্জা নাই এটা আমি তাদের কাছ থেকেই শিখছি। আমি যখন আমার প্রথম বই নারগিস এর বুক সাইনিং ইভেন্ট করলাম চট্টগ্রামে, আমার স্কুলের বান্ধবীরা, ছোটবেলার কোচিং এর টিচার, পাড়ার বড়ভাই—সকলে লাইন ধরে এসে বই কিনল। যদিও আমি জানি এগুলা একটাও বই পড়ে না, হয়ত ধরেও না। 

আমার কোনো কোনো বন্ধু আমার বই দিয়ে মাউস প্যাড বানিয়েছে তবু আমার কোনো বই বের হলে কিনবেই, কারণ বন্ধুর বই বলে কথা! আমি ওদের কাছ থেকে এটা যেমন শিখছি আবার এটাও বুঝছি যে সকলের বন্ধু ভাগ্য এত ভালো হয় না। নাহলে মেলায় লেখকরা পাঠকদেরকে বই কিনার জন্য জোরাজুরি করার যে অভিযোগ (!) শোনা যায় সেটা শোনা যেত না।

— বইমেলা আসলেই প্রতিবছর কতগুলো আহাম্মক ফেসবুকে লেখতে শুরু করে “বাংলাদেশে পাঠকের চেয়ে লেখক বেশি”, “সবাইকে কেন লেখক হতে হবে”, “বাংলাদেশে কবি ও কাকের সংখ্যা সমান সমান”, “এত বই কেন বের হয়”, “আসল লেখকরা হারায়ে যাচ্ছে, মোটিভেশনাল লেখক/নায়ক নায়িকা কেন বই লেখতেছে” ইত্যাদি ইত্যাদি। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে যদি লেখক-কবি-সাহিত্যিক থাকে তাহলে সেটা গর্বের কথা। কিন্তু আসল ঘটনা তো সেটা না। ঘটনা হলো বাংলাদেশে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা খুবই কম। তার মধ্যে সবাই লিখতে পারে না বা বই প্রকাশ করতে পারে না। যারা পারে তাদের প্রতি যারা পারে না তাদের একটা অসূয়া/হিংসা/বিদ্বেষ থাকেই। এ কারণেই এইসব বলে ও লেখে। 

এর বাইরে মজা করেও বলে। মজা করে বলুক আর হিংসা করে বলুক ওদের বলা যেমন ঠিক আছে, তেমন এত লেখক-কবি-সাহিত্যিক থাকাও ঠিক আছে। পাঠকদের তরফে কাক ও কবির তুলনা যেমন চলবে তেমনি লেখকদের তরফে পাঠকদের “উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য” পড়া পাঠক ডাকাও চলবে। আমি দুই পক্ষকেই সমর্থন করি এবং এত বই প্রকাশ হওয়াতে কোনো সমস্যা দেখি না। 

— বইমেলার কারণে আমি জীবনে প্রচুর টাকা আয় করছি। ছাত্রজীবনে এমন কোনো খ্যাপের কাজ নাই যেটা আমি করি নাই। ট্রান্সক্রাইব, প্রুফ, এডিট ও গোস্ট রাইটিং—এগুলো করে আমার বহুদিনের সংসার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়েছে। বড়লোকদের আত্মজীবনী লিখে দিয়ে আমি ঢাকা শহর থেকে বহু আরাম আয়েশ স্বাধীনতা যেমন পাইছি, তেমন বুক রিভিউ লেখার জন্য আমাদের পরিচিত লেখকদের বই পড়ার যন্ত্রণায় আত্মহত্যাও করতে চাইছি। বাজে জিনিসগুলো পড়ার অভিজ্ঞতা বাদ দিয়ে, স্বনির্ভরতার সহায়তাটুকু যদি ধরি— আমার জীবনে বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীমই বলতে হবে। 

—সময় টিভির রিপোর্টার হিসেবে ৬ বছর বইমেলাতে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছি। সেটা খুবই জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল। যদিও আমার জন্য সেটা ছিল “অর্ধেক কমেডি তার অর্ধেক ট্র্যাজেডি”। আমার সহকর্মীদের কেউ কেউ এ অনুষ্ঠানের জন্য আমাকে খুব হিংসা করতেন, ভাবতেন কতই না মজা (হয়ত টাকাও!) আমি পাই এ অনুষ্ঠান করে। 

আমি যে মনে মনে চাইতাম “বইমেলার ধরণী দ্বিধা হোক আর আমি সেইখানে ঢুকে যাই” এইটা কেউ জানতে পারে নাই। এই “কমেডি টু ট্রাজেডি শো” এর গল্প নাহয় আরেকদিন লিখবো। আজ এই পর্যন্তই লিখি। লেখার দৈর্ঘ্য বড় হয়ে যাবে। 

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)


বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর