২১ এপ্রিল, ২০২২ ২৩:৫৫

নাম বিভ্রাট

ডা. মাহবুবর রহমান

নাম বিভ্রাট

ডা. মাহবুবর রহমান

আমি যেখানে কাজ করি সেখানে তিনজন মাহবুব আছে। এরকম অবশ্য সবখানেই আছে। আমি যখন ক্লাস ফোর এ পড়ি তখন আমাদের ক্লাসে দু'জন বিধান ছিল। একজন ছোটখাটো বিধান, আরেকজন দশাসই বিধান। আমরা বন্ধুরা ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটিকে পিচ্চি বিধান আর অন্যদিকে জাম্বু বিধান বলে ডাকা শুরু করলাম। কিন্তু এটা তো সরকারীভাবে স্বীকৃত ছিল না। আমাদের হেডস্যার ছিলেন অত্যন্ত ভালো মানুষ আলতাফ স্যার। তিনি এই সংকট থেকে আমাদেরকে উদ্ধার করলেন। পিচ্চি বিধান হলো লিটল বিধান আর জাম্বু হলো গ্রেট বিধান। তবে আকারে গ্রেট হলেও প্রকরণে ততখানি গ্রেটত্ব দেখাতে পারত না। ফলে আলতাফ স্যারের ১৮০ ডিগ্রী কানমলা ছিল গ্রেট এর নিত্যদিনের প্রাপ্য ভোগ। সেটাকে অবশ্য দুর্ভোগও বলা চলে।

নামের এই বিভ্রাট যে কতরকম হতে পারে তা চারিদিকে তাকালেই বোঝা যায়। যেমন ছিনতাইকারী দলের দুই তরুণ সদস্যের নাম কামাল। বিভ্রান্তি দূর করতে দলপতি মুরগীমিলন একজনকে গালকাটা কামাল, আরেকজনকে গলাকাটা কামাল নাম দিলেন। যদিও দু'জনেই গাল ও গলা উভয় বস্তু কাটতে সমান সিদ্ধহস্ত।

সে যাই হোক। আমার কর্মক্ষেত্রে তিনজন মাহবুব বিদ্যমান। একজন সনোগ্রাফীতে বিশেষজ্ঞ, যাঁকে প্রকাশ্যে মিতা বলে ডাকি (গোপনে আমরা বলি আঠা লাগানো ডাক্তার!), একজন অবেদনবিদ বা এনেসথেটিস্ট , যাঁকে প্রকাশ্যে বড়দা বলে ডাকি (রোগীকে অজ্ঞান করেন বলে গোপনে আমরা ডাকি  অজ্ঞানপার্টি!) আর তৃতীয়জন হলাম আমি অভাগা হৃদপিণ্ডবিদ (অন্য দু'পক্ষ গোপনে আমার নামে যে কী পিণ্ডি দেয় তা আল্লাহ্ মালুম!)। 

তো সবার সাথে এই তিনজনের ফোন নম্বরও হাসপাতালের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এবং কল সেন্টারে রক্ষিত আছে। তাই এসকল নম্বরে রোগীদের উন্মুক্ত অধিকার। ফলে প্রায়ই নিম্নরূপ কল আসে-

-হ্যালো ভাই আমি কলাবাগান থেকে বলছি। আমার কিডনির সনোগ্রাম করাতে হবে। সকাল থেকে পানি খাচ্ছি, আর তো পেশাব ধরে রাখতে পারছি না। একটু তাড়াতাড়ি করে দিবেন?
-জ্বী জ্বী নিশ্চই। আমি আঠা ভাইকে ফোন করে অনুরোধ করে দিলাম। 

এদিকে অবেদনবিদ মাহবুব সাহেব হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার সাথেও জড়িত। আমি তাঁকে যেহেতু বড়দা বলে ডাকি তিনিও আমাকে স্নেহভরা গলায় ছোটদা বলে ডাকেন। তো নামের ক্রসকানেকশন হয়ে কোনো কল এলো নিম্নরূপ -
-হ্যালো লিডার আমার সম্বন্ধির বউ আপনার হাসপাতালে নরমাল বেডে ভর্তি আছে। সে তো কমন টয়লেট ব্যবহার করতে পারে না। তার জন্য একটা কেবিনের ব্যবস্থা করেন।

আমি ভদ্রলোকের সম্বন্ধির দুর্দশা চিন্তা করে কাস্টমার কেয়ারকে একটা কেবিনের ব্যবস্থা করে দিতে বললাম। একইভাবে হৃদপিণ্ডের রোগীরা কখনো সনোগ্রাফী মিতার কাছে, আবার কখনো অবেদনবিদ বড়দার কাছে হার্টে রিং পরাবার আবদার নিয়ে ফোন করে বসেন। তাঁরাও একই প্রক্রিয়ায় রোগী মহোদয়দেরকে সঠিক পথ নির্দেশপূর্বক রিডিরেক্ট করে আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। 

এভাবে নামের বিভ্রাটের মধ্যে এক ধরণের বিড়ম্বনা থাকলেও আমরা তিনজনে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। সত্যি বলতে কি এর মধ্যে এক প্রকার সূক্ষ্ম রসের আস্বাদনও আমরা পেতাম। 

তবে রোগীদের ক্ষেত্রে তা কখনো কখনো বিস্বাদের কারণও হয়ে দাঁড়ায়। যেমন একদিন সকালে চেম্বারে রোগী দেখছি। টেবিলে বেশ কিছু রোগীর ফাইল। উপরের ফাইলটি নাসিমা ইসলামের। কলিং বেল দিয়ে সহকারীকে বললাম রোগী দিতে।

সৌজন্য বিনিময় শেষে রোগীকে জিজ্ঞাস করলাম-
আপনার নাম নাসিমা?
-জ্বী। 
পুরাতন ফাইলে নাম মিলিয়ে নিলাম। ঠিকানা মোহম্মদপুর। তবুও নিশ্চিত হতে জিজ্ঞাস করলাম- মোহাম্মদপুরে থাকেন?
-আগে থাকতাম। এখন থাকি আশকোনা। 
রোগীর মুখে মাস্ক পরা থাকায় চিনবার জো নেই। যাই হোক রোগীর বৃত্তান্ত জেনে নতুন কিছু ওষুধ লিখে কিছু পরীক্ষা করবার উপদেশ দিয়ে শেষ করলাম। পরবর্তী রোগীর জন্য সহকারীকে কল করলাম। যথারীতি পরের রোগী ঢুকে সৌজন্য বিনিময় করলেন। ফাইলে চোখ বুলাতে দেখি এর নামও নাসিমা। সর্বনাশ! 
বললাম- আপনার নাম কি? 
-নাসিমা ইসলাম।
-বাড়ি? 
-মোহম্মদপুর।

ফাইলে চোখ বুলাতেই দেখলাম রোগীর নাম নাসিমা আকতার। বাড়ি মোহাম্মদপুরে। বুঝলাম ইসলাম আর আকতারে গণ্ডগোল বেঁধেছে। সব “চিনিপাতা কই, মাছখানি দই” হয়ে গেছে। কম্পিউটারে আগের রোগীর ফাইল থেকে মোবাইল ফোনের নম্বর নিয়ে তাড়াতাড়ি কল করলাম। কোনো প্রকারে বড় কোন ভুল থেকে রক্ষা পেলাম। নইলে কিডনি ফেইল্যুরের রোগী হার্ট ফেইল্যুরের চিকিৎসা পেয়ে মহাবিপত্তি ঘটাতো। 

যাই হোক কর্মক্ষেত্রে আমাদের তিন মাহবুব মিলে একরকম সমঝোতামূলক সহাবস্থান চলছিল। এরমধ্যে হঠাৎ করে সনোগ্রাফী মিতাভাই আখেরাতে বেহেস্তের অপেক্ষা না করে দুনিয়ার বেহেস্ত আমেরিকায় পাড়ি জমালেন। ফলে ক্রসকানেকশন তিন থেকে দুইয়ে নেমে এলো। 
ইতিমধ্যে করোনার দ্বিতীয় থাবা আমাদের দরজায় হানা দিল। দিকে দিকে আতঙ্কের ত্রাস সবাইকে গ্রাস করতে উদ্যত হলো। দীর্ঘ প্রায় এক বছর করোনাকে এড়িয়ে চলতে সক্ষম হলাম। তবে হার্ট এটাক নিয়ে আসা অনেক রোগীর উপসর্গহীন করোনা লুকিয়ে থাকায় আমরা ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে থাকলাম। অবশেষে শেষ রক্ষা আর হল না। করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলাম।

আমার মনে হয় করোনার মূল আঘাতটি মানসিক আঘাত। আতঙ্ক আর ত্রাসসঞ্চার এর মূল শক্তি। যদি প্রথম ধাক্কাটি সামাল দেয়া যায় তবে শারীরিক বিপর্যয় সামাল দেয়া অনেক সহজ হয়ে যায়। মানসিক প্রস্তুতি আমার ভালোই ছিল। তাই মূল ধাক্কাটি আমাকে বিচলিত করতে সক্ষম হয়নি। তারপর শারীরিক ধাক্কা চিকিৎসাবিজ্ঞান দিয়ে সামলে নিতে আর অসুবিধা হয়নি। 

কোভিড ইউনিটের কেবিনে পুরোপুরি একা শুয়ে বসে সময় পার করলাম এক সপ্তাহ। সে এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। সবাই আন্তরিকভাবে খোঁজ খবর নিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবিক কারণেই কেউ সামনাসামনি হতে পারছে না। কেবল আমার বন্ধু অধ্যাপক আব্দুল হানিফ টাবলু সব বাধা উপেক্ষা করে আমাকে দেখতে কেবিনে ঢুকে পড়ল। অনেক শুভানুধ্যায়ী কল করে, বার্তা পাঠিয়ে তাদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। অনেক রোগী আমার কোভিড আক্রান্তের খবর শুনে এমনকি মসজিদে দোয়ার অনুষ্ঠান করেছেন। মানুষের প্রতি আমার দায়বদ্ধতাকে তখন সার্থক মনে করেছি। 

আমি সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফেরার পরপর অবেদনবিদ আমার বড়দা ডা. মাহবুব কোভিডে আক্রান্ত হন। খবরটি জেনে চিন্তাগ্রস্ত হই। কেননা তাঁর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং ষাটোর্ধ্ব বয়স সব মিলিয়ে তাঁকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। 

চিকিৎসা বিজ্ঞানে থাকা সব ধরণের চিকিৎসা বড়দাকে দেয়া হলো। কয়েকবার সব বিশেষজ্ঞকে নিয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হলো। বেঁচে থাকবার সে যে কী আকুতি, জীবনের প্রতি সে যে কী মোহময় ভালোবাসা তা বড়দার কথায়, মোবাইলের খুদে বার্তায় এবং চোখের দৃষ্টিতে বারবার দেখতে পেয়েছি। কিন্তু স্পিনোজা ঈশ্বরের অভিপ্রায় ছিল অন্যরকম। দীর্ঘ এক মাসেরও অধিক সময় মরণপণ যুদ্ধ করে বড়দা হেরে গেলেন!

পরদিন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবরটি বেশ প্রচার পায়। আমার পরিচিত অনেক রোগী, বন্ধুবান্ধব চাপা শঙ্কা নিয়ে আমাকে ফোন করেন। অজানা আতঙ্কে জিজ্ঞাস করেন আমি সুস্থ আছি কিনা। তারা ধরে নিয়েছিলেন আমিই সম্ভবত মারা গেছি। 

পরদিন মন খারাপ করে চেম্বারে রোগী দেখছি। নানান স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। তিন মাহবুব থেকে একজনে এসে ঠেকল। দীর্ঘদিন একই ছাদের নীচে কাজ করেছি। কখনো মধুর, কখনো তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। কিন্তু পরস্পরের প্রতি সৌজন্যবোধ, সৌহার্দ্য কখনো ভুলে যাইনি। 

হঠাৎ দরজা ঠেলে মধ্যবয়সী একটি নারী রুমের ভেতরে ঢুকে পড়ল। প্রথমে কয়েক মুহূর্ত সে আমার দিকে অপলক উদ্ভ্রান্তের মত তাকিয়ে থাকল। যেন সে বিশ্বাস করতে পারছিল না তার সামনে সত্যি আমি জীবন্ত  বসে আছি। তারপর  “ও আংকেল আপনি বেঁচে আছেন?” এই বলে আমার পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

আখেরাতের বেহেস্ত কোথায় আছে জানি না। দুনিয়ার বেহেস্ত আমার সামনে পড়ে থাকতে দেখলাম। 

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক : সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট ও সিসিইউ ইনচার্জ, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ধানমণ্ডি, ঢাকা।


বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর