১৪ জুলাই, ২০২২ ০৮:১৯

ছাপাখানার ভূত: “চ” এর স্থলে “ব” হলে কী ঘটে!

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

ছাপাখানার ভূত: “চ” এর স্থলে “ব” হলে কী ঘটে!

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে চালের ঘাটতি পড়লে পাশের দেশ বার্মা (মিয়ানমার) থেকে হরহামেশাই চাল আমদানি করা হতো। সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত খবরও ছাপা হতো। একবার এক দৈনিকে সিঙ্গেল কলামে “বার্মা থেকে ৪০ হাজার টন চাল আমদানি করা হবে” হেডিংয়ে “চাল” এর “চ” এর জায়গায় “ব” অক্ষরটি শোভা পায়। পাঠকদের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে বার্মা থেকে আসলে কী আমদানি করা হচ্ছিল। মুদ্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মকে বোঝানো কঠিন যে কম্পোজিটর কীভাবে তার সামনে সামনে এবং উভয় পাশে কাঠের খোপ থেকে একটি একটি অক্ষর তুলে শব্দ, বাক্য সাজাতেন। এক একটি খোপ এক একটি অ্যালুমিনিয়ামের পৃথক অক্ষর, আকার, একার, কমা, সেমিকোলন সহ যাবতীয় চিহ্ন থাকতো। দুর্ভাগ্যক্রমে “চ” ও “ব” অক্ষরের খোপ দুটি পাশাপাশি। কম্পোজিটর একজন মানুষ, তারও ভুল হয়, অতএব তিনি “চাল” এর “চ” এর স্থলে “ব” বসান। প্রুফ রিডাররা সাধারণত তিনবার করে প্রুফ দেখতেন। তবুও কিছু কিছু ভুল রয়ে যেতো। প্রফ রিডাররাও মানুষ, তাদেরও ভুল হতো। 

বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমানকে নিশ্চয়ই লোকজন এখনও মনে রেখেছেন। সত্তরের দশকে তিনি তাঁর নাম “সাইফুর” না লিখে “ছয়ফুর” লিখতেন। আমি যে দৈনিকের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম, সেই দৈনিক সংগ্রামে “ছয়ফুর” এর শেষ অক্ষর “র” এর পরিবর্তে “ট” বসে তার নাম দাঁড়ায় “ছয়ফুট রহমান”। তিনি তখনও মন্ত্রী হননি। নিজেই ফোন করেন তখনকার সম্পাদক অধ্যাপক আখতার ফারুককে এবং ভুলটি সম্পর্কে আপত্তি জানান। আখতার ফারুক অত্যন্ত রসিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি প্রচুর পান খেতেন এবং প্রচুর হাসতেন। হাসতে হাসতে ছয়ফুর রহমানকে বলেন, “আপনাকে তো খাটো করিনি, আপনার উচ্চতা “ছয় ফুট” না হলেও আমরা আপনাকে “ছয়ফুট” করে দিয়েছি। 

বিএনপি’র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে মরহুম রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সামনে রেখে পরীক্ষামূলকভাবে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে ১৯৭৭ সালে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়েছিল। দৈনিক ইত্তেফাকের এক উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধে “জাগদল” হয়ে যায় “ছাগদল”। এটি তখন সরকারি দল হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে যেকোনো সরকারি দলের যে দাপট থাকে, ‘জাগদল’ এর তা ছিল। দলটির পক্ষ থেকে প্রতিবাদলিপি পাঠিয়ে সংশোধনীসহ ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হয়। দুনিয়াতে কোনোকালেই ত্যাদড় লোকের ঘাটতি ছিল না, বাংলাদেশেও ছিল না, এমনকি ইত্তেফাকেও ছিল না। পরদিন সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় একটি উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধের কেন্দ্রস্থলে আগের দিনের ভুলের কারণে “ভ্রম সংশোধন” শিরোনামে একটি বক্স আইটেম ছাপা হয়, তাতে যা লেখা হয়েছিল তা মোটামুটি এমন: “গতকাল --- তারিখের দৈনিক ইত্তেফাকের উপ-সম্পাদকীয়তে মুদ্রণ প্রমাদবশত “জাগদল” এর নাম “ছাগদল” মুদ্রিত হইয়াছে। প্রকৃতপক্ষে ইহা “ছাগদল” না হইয়া “জাগদল” হইবে। উক্ত নিবন্ধের যেসব স্থানে “ছাগদল” মুদ্রিত হইয়াছে সেগুলিকে “জাগদল” পড়িতে হইবে। “জাগদল” এর স্থলে “ছাগদল” মুদ্রিত হওয়া সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ও অনভিপ্রেত। এই জন্য আমরা দু:খিত।” 

এমন আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে, যা আমার চেয়ে অভিজ্ঞরা আরও চমৎকারভাবে বর্ণনা করতে পারবেন। এখন সংবাদপত্র হোক, বইয়ের প্রকাশনা হোক, মুদ্রণ শিল্প অনেক অগ্রসর হয়েছে। কোনো মুদ্রণ প্রমাদ ঘটলে “ছাপাখানার ভূত” এর দোষ দেওয়ার সুযোগ কম। কিন্তু প্রমাদ কি শেষ হয়েছে? না, শেষ হয়নি। বরং বেড়েছে। কিন্তু সেসব প্রমাদ মুদ্রণজনিত বা ছাপাখানার ভূতের কারণে নয়, যারা প্রমাদ ঘটায়, তারা তা ঘটায় তাদের বুদ্ধিগত সীমাবদ্ধতার কারণে। চলতি বছরের ১৩ মে তারিখে দৈনিক ইনকিলাবে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতির ওপর প্রকাশিত এক রিপোর্টে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বক্তৃতার একটি লাইন : I’m going to work like the devil to bring gas prices down,, এর অনুবাদ করা হয়েছে: “গ্যাসের দাম কমানোর জন্য আমি শয়তানের মতো কাজ করতে যাচ্ছি।” নি:সন্দেহে একজন জুনিয়র সাব-এডিটর রিপোর্টটি অনুবাদ করেছেন এবং একজন জুনিয়র যদি “Raining cats and dogs” এর অনুবাদ “মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে”র পরিবর্তে “বিড়াল ও কুকুরের মতো বৃষ্টি হচ্ছে” অনুবাদ করেন, সেক্ষেত্রে আমি অবাক হবো না। কিন্তু তার ভুল ধরার জন্য তার ওপরেও এক বা একাধিক ব্যক্তি থাকেন। তারা জুনিয়রের ভুল সংশোধন না করলে তারা জীবনভর বাইডেনকে “শয়তান” বানাবেন এবং বৃষ্টি বিড়াল-কুকুরের মতো ঝরতে থাকবে। 

আমি বলি, বাবারা, নিজে সঠিকভাবে জানো এবং অন্যকেও সঠিক জানতে সহায়তা করো। চোখ কান একটু খোলা রাখো, কিছু জানার জন্য এখন তো আর আমাদের সময়ের মতো ব্রিটিশ কাউন্সিল বা আমেরিকান সেন্টারে ছুটতে হয় না। ঘরে বসে মুহূর্তেই জানতে পারো সব। যেসব উপায় উপকরণ আছে তার যথাযথ এস্তেমাল করো। ‘ইডিয়ম’ বা বাগধারা’ বলে একটি বস্তু আছে, তাতে যা বলা হয়, প্রকৃত অর্থ তার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। জো বাইডেনের work like the devil একটি ইডিয়ম, যা তিনি একথা বোঝাতে ব্যবহার করেছেন যে “গ্যাসের (আমেরিকায় গ্যাস বলতে বোঝায় জ্বালানি তেল) দাম কমাতে তিনি তাঁর পূর্ণ শক্তি কাজে লাগাবেন এবং ও ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন।”


(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

 

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর