১০ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৩:০৬

মেসির টোপো গিগিও সেলিব্রেশন এবং দুটি রহস্য

দেবব্রত মুখোপাধ্যায়

মেসির টোপো গিগিও সেলিব্রেশন এবং দুটি রহস্য

দৃশ্যটা খুব চেনা।

মেসি গোল করলেন। কর্নারে ছুটে গেলেন এবং সব সতীর্থ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এরপর কী হবে, তাও জানা। মেসি বুকে ক্রুশ আঁকবেন এবং দু হাত ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে আকাশে তুলবেন। কিন্তু, না।

কাল রাতে একটু ব্যতিক্রম হলো। একটু হেঁটে নেদারল্যান্ডস বেঞ্চের সামনে গেলেন মেসি। হাত দুটো কানের পেছনে নিলেন, করতালু ছড়িয়ে দিয়ে একটা “অচেনা” ভঙ্গি করলেন। এ কালের দর্শকরা অবাক হয়ে ভাবলেন, এটা আবার কী?  আর আমরা যারা একটু বুড়িয়ে গেছি, তারা কেঁপে উঠে বললাম- এ তো সেই রিকেলমে!

হ্যা, এমন সেলিব্রেশন করতেন হুয়ান রোমান রিকেলমে। গোল করা তার খুব বেশি কাজ ছিলো না। রিকেলমে ছিলেন মিড ফিল্ড জেনারেল। তারপরও ডেড বলে অসাধারণ সব গোল ছিলো তার। গোল করলেই কানের পেছনে হাত নিয়ে এই সেলিব্রেশনটা করতেন। এটাকে দেখছি মিডিয়া বলছে, টোপো গিগিও সেলিব্রেশন। একটা অতি পুরোনো কার্টুনের চরিত্র থেকে এসেছে এই নামটা। বলাই বাহুল্য, রিকেলমে এই কার্টুনের খুব ভক্ত ছিলেন।

কিন্তু মেসি তো ভক্ত নন। তাহলে তিনি কেনো এই সেলিব্রেশন করলেন? আর সেটা লুই ফন গালের সামনে কেনো? এখানে একটা গল্প আছে। এটা জানতে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে।

সেটা ২০০২ সালের ঘটনা। রিকেলমে তখন বোকা জুনিয়র্সরে কিংবদন্তী হতে বসেছেন। ৭ বছরে ৬টি মেজর জিতেছেন। এ হেন রিকেলমেকে কিনে আনলো বার্সেলোনা। সেটাকে বলা হয় বার্সেলোনার “অন্ধকার যুগ”। কারণ বার্সেলোনার দায়িত্বে তখন এই লুই ফন গাল। আর তার ডেপুটি হিসেবে আসল কর্মকাণ্ড সামলাতেন হোসে মরিনহো। সারা জীবন ক্রুইফের পথে ছন্দের ফুটবল খেলা বার্সেলোনাকে তখন পাওয়ার ফুটবল এবং বাস পার্কিং খেলাচ্ছেন ফন গাল-মরিনহো জুটি। তাই এরা কোনোভাবেই রিকেলমের মত চরম ধীরগতির ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডারকে মেনে নিতে পারলেন না।

ফন গাল প্রকাশ্যে বললেন, রিকেলমেকে তিনি পছন্দ করে কেনেননি; এটা ক্লাবের পলিটিক্যাল সাইনিং। ফলে রিকেলমের খুব একটা মাঠে নামা হলো না। যা দু একটা ম্যাচে বদলি হিসেবে মাঠে নামতেন, খেলতে হতো উইংগার হিসেবে।

চ্যাম্পিয়নস লিগের একটা ম্যাচে শুরুর একাদশে ছিলেন রিকেলমে। আর সেখানেই গোল করে এই টোপো গিগিও সেলিব্রেশন করেছিলেন তিনি ফন গালের দিকে ফিরে। সেখানেই আসলে রিকেলমের ইউরোপ ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়। এরপর ভিলারিয়ালে খুব সফল সময় পার করলেও সেই অর্থে ইউরোপীয় হয়ে উঠতে পারেননি এই মাঝ মাঠের জাদুকর।

এবার বুঝতে পারলেন, মেসি কেনো ফন গালের সামনে রিকেলমের সেলিব্রেশনটাই করলেন?

না,  সবটা এখনও বুঝতে পারেননি। আরেকটু গল্প আছে। বলা ভালো,  আরেকটা প্রশ্ন আছে—রিকেলমের সঙ্গে মেসির সম্পর্ক কী তাহলে এতো ভালো যে,  রিকেলমের হয়ে প্রতিশোধ নিলেন মেসি? না, দু জনের গোলমালেই রিকেলমের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়েছিলো। সেখানেই গল্পটা।

২০০৬ সালের দিকে মেসি যখন প্রথম জাতীয় দলে এলেন, তখন তিনি রিকেলেমের ছোট ভাই ছিলেন। এখনও গুগলে দু জনের জড়াজড়ি করা অনেক ছবি দেখতে পাবেন। দু’জনের জন্মদিন এক দিনে, তাই পরস্পরকে তারা ভাই বলেই মনে করতেন।

কিন্তু গোলমাল লাগালেন ম্যারাডোনা। ২০১০ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে রিকেলমে ইনজুরিতে ছিলেন। সেই সময়ে ১০ নম্বর জার্সি পরতেন রিকেলমে। তার ইনজুরিতে সেই জার্সি মেসিকে দিলেন ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনার মিডিয়ার দাবি, এই জার্সি কাণ্ডেই আর জাতীয় দলে ফিরতে রাজি হননি রিকেলমে।

খোদ মেসি তার কাছে গিয়ে ১০ নম্বর ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু রিকেলমে রাজি হননি। ২০১০ বিশ্বকাপে রিকেলমেকে না পাওয়াটা মেসিদের জন্য বড় একটা ধাক্কা ছিলো। তাহলে মেসির নিশ্চয়ই রিকেলমের ওপর খুব রাগ?

আজ বোঝা গেলো, মেসির ওই বুকটায় কারো জন্য রাগ নেই। কেবলই ভালোবাসা নিয়ে ঘুরছেন তিনি তার বন্ধু, ভাই এবং বড়দের জন্য। এই সেলিব্রেশন বলে দিলো, মেসি কিছু ভোলেননি। সবই যত্নে রেখে দিয়েছেন।

মেসি কেবল নিজের জন্য বিশ্বকাপে খেলছেন না। বছরের পর বছর বঞ্চিত হওয়া কয়েকটা প্রজন্মের জন্য লড়ে চলেছেন তিনি। 
বাবা,  ভাই,  বন্ধু এবং আত্মীয়;  সকলের বদলা নেওয়ার পালা এবার।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর