১৯ জুন, ২০২৩ ১৫:৫২

চায়না ফনিক্স সাইকেল, আমি আর আব্বা

এ এস এম হাফিজুর রহমান

চায়না ফনিক্স সাইকেল, আমি আর আব্বা

এ এস এম হাফিজুর রহমান

আব্বার সঙ্গে আর কোন ছবিই নেই আমার। সব ভিজে গেছে ৮৮'র বন্যায়। যা আছে শুধু স্মৃতি হয়ে-  তাতেও আবার লেগে আছে -অনাবৃষ্টি,খরা আর ফালি-ফালি অনাবাদী জমি। কালো ফ্রেমের চশমা।তার নিচে একখানা শ্যামলা রঙা মুখ; কালো মেঘ বিষণ্ণতা। কপালে সেজদাহ'র স্পষ্ট গোলাকার দাগ। তাহাজ্জুদ শেষে ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরছেন আব্বা। অতঃপর দরাজ কণ্ঠে অসীম প্রার্থনায় 'বালাগাল উলা বে কামালেহী, কাসাব্বা দুজা বি জামালিহী' এসব-ই মনে আছে শুধু।

শুক্রবার সাপ্তাহিক বড় হাট। চায়না ফনিক্স সাইকেল, আমি আর আব্বা। চলি চুপচাপ। ঘামে ভেজে সাদা শার্ট। আমি সেই ঘামের গন্ধ নেই। বড্ড মায়াঘেরা, পবিত্র, মিহি একটা অনুভূতি পকেটে ভরি।ভাজাখোয়া, ফাঁসিদহ, হাঁড়িপুকুর শেষে আসি লাহিড়ীর হাট। ঠাকুরের চালিতে তখন তপ্ত দুপুর।সামনে সারবেঁধে জালের দোকান। হঠাৎ দুম করে বৃষ্টি নামে। আমি জালের ফোড় দিয়ে বৃষ্টি দেখি।আব্বা দ্যাখেন অন্যকিছু,সেটা -ঘড়ির সময়, টনা জব্বার, জিন্নাতুল চাচা কিংবা ভেলাজানের মংলু পাঞ্জিয়ার সব হতে পারে।

বাজার শেষে আবার বাড়ি ফিরি সেই তিন। ও-ই একই পথ। তপ্ত নয় বৃষ্টিস্নাত। ভাবনাগুলো ভিন্ন এবার। কিছু হাসির, কিছু আনন্দের, কিছু বিষাদের গল্পও বলে যান আব্বা। আমি চুপচাপ বসে বসে নিমকি চিবোই। আব্বা গুনগুন করে গেয়ে উঠেন- 'তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়'। আমরা তখন মোহনের পুলের উপর। সেখানে নিম গাছের ঘন ছায়ায় মলিন শাড়িতে শুকনো মুখে বসে আছে মানিক শরী। আমার দাইমা ছিলেন তিনি। আব্বাকে দেখেই হু হু করে কেঁদে উঠলেন। বড্ড ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত মনে হলো মানিক শরী'কে। জীবনের জয়-পরাজয়ের চেয়ে ক্ষুধাই যেন মানিক শরী 'র কাছে বড্ড বিপ্রতীপসম। ক্ষুধার পৃথিবী তার কাছে ভীষণ ক্ষুরধার হয়ে উঠেছিল ধীরে ধীরে। 

দলিল মুয়াজ্জিনের আযান ভেসে আসলো কানে। আসরের নামাজ ধরতে আব্বা প্যাডেল চালান দ্রুত। বাড়ি ফিরি আমরা। সন্ধ্য নামলো ধীরে। ''জ্যামিতি বক্স এনেছো আব্বা' বড় ভাইয়ার এমন প্রশ্নে হেসে উঠেন আব্বা। "আহারে বেটা, আজ কিনতে এতোটকুন মনে নেই বাবা, সামনের হাটেই কিনে এনে দিবো'' -ভাইয়ার কপালে আদর করে বলতে থাকেন। আম্মা এসব দৃশ্য খুব ভালো বোঝেন। কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান যেন। মেজো ভাইয়া আর আমি হারিকেন মুছি। কবুতরের খাঁচার দরজা লাগান আব্বা। লাল গরুটাকে খাবার খেতে দেয় আম্মার সহকারি যোমনী বেটি। আম্মা সেলাই মেশিন বারান্দা থেকে ঘরে নিয়ে যান।

আবার কালো মেঘে ছেঁয়ে যায় আকাশ। শুরু হয় দমকা হাওয়া। বিদ্যুৎ চমকে-চমকে উঠে নারিকেল গাছগুলোর উপর। সজনা গাছটা মট করে ভেঙে পড়ে। কবুতরগুলো সব চুপ করে থাকে। দূর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। আখিলনের মেয়ে শেফালি চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে-' রংপুরিয়া মোক মারি ফেলাইল গে চেয়ারম্যান ভাই''। স্বামী সলিম রংপুরিয়া চুলের ঝুঁটি ধরে বেদম মার মেরেছে একটু আগেই। বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দে একসময় কান্না মিলিয়ে যায় শেফালীর।

ঝড় থামেনা। বাড়েই শুধু। এই প্রলংকারী ঝড় থামতে আব্বা বারান্দায় দাঁড়িয়েই আযান দেন' আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার'। আযান দিয়েই খুব ক্লান্ত হয়ে যান। দাঁতের পুরনো ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠে। আম্মা নরম ভাত খেতে দেন আব্বাকে। আমরা তখনো পাটিতে বসে পড়ছি। আব্বা আমাদের দিকে একবার তাকিয়ে আবার বাইরে তাকালেন। একটু হাসলেন। প্রাশান্তির পরশ ছিল হাসিতে। বৃষ্টি থেমে গেছে তখন। অন্ধকার কেটে গিয়ে ফর্সা হয়েছে আকাশ। হারিকেনের আলোতে আব্বার তাকানোটা স্পষ্ট চোখে পড়লো আমার। হারিকেনের আলোর চাইতে আরো কোন বড় আলো দেখতে পেলেন কিনা কে জানে?

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক: এডিসি, গুলশান বিভাগ (ট্রাফিক)

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর