পাহাড়ের পর পাহাড়। কখনো গিরিখাদ, কখনো আবার আঁকা-বাঁকা নদী। প্রকৃতি যেন উজার করে দিয়েছে নিজেকে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, কিংবা বসন্ত রূপের জৌলুস থাকে এখানে সারা বছরই। পার্থক্য কেবল ঋতুর সাজে। অপরূপ সৌন্দয্যে ভরপুর পার্বত্যাঞ্চল। এখানে চলে পাহাড়, নদী আর ঝর্ণার হৃদের মিলনমেলা। এখানকার প্রতিটি পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অদেখা ভুবন। রয়েছে নয়নাভিরাম দৃশ্যপট। শরৎ আর হেমন্ত আসলেই, সবুজ পাহাড়ে তৈরি হয় মেঘের রাজ্য। নীল আকাশের মেঘের ভেলায় ভাসতে থাকে পাহাড়। সারাদিন চলে নীল, সাদা ও সবুজের লুকোচুরি খেলা। সন্ধ্যার আকাশে গোধূলীর রঙ ছড়াতেই ঝাঁক বেধে আসে বনের পাখিরা। তাদের খুনসুটি দেখে মুগ্ধ দর্শনার্থীরা। এর টানে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে আসছেন হাজারো দেশি-বিদেশি পর্যটক।
নানা বৈচিত্র্যের ভাণ্ডারের সমৃদ্ধ রাঙামাটি সবার কাছে রূপ কথার গল্পের মত পরিচিত বলছেন ফরিদপুর জেলা থেকে বেড়াতে আসা পর্যটক কামরুল। তিনি বলেন, যান্ত্রিক জীবনে এমন বৈচিত্রের কথা চিন্তা করা যায় না। পাহাড় আর অরণ্য নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। কিন্ত বাস্তবতা এর চেয়ে ভিন্ন। পাহাড়ে এতো রূপ লুকিয়ে আছে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যেতো না।
অন্যদিকে, দীর্ঘদিনের টানা তাপদাহ থেকে যেন মুক্তি পেয়েছে পাহাড়। এরই মধ্যে শীতের আমেজ বইতে শুরু করেছে এখানে। স্নিগ্ধ বাতাস আর শিশিরের বিন্দু বিন্দু জল যেন জানান দিচ্ছে শীতের আগাম বার্তা। পাহাড়ে ঘুরার এটা উত্তম সময় বলে মনে করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। তাই পর্যটক বরণ করতে এরই মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করেছে তারা। রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বলছেন, রৌদ বৃষ্টির দিন শেষ। হেমন্তের সাথে বয়ে আসছে শীত। রাঙামাটি এখন পূর্ণ রূপে আছে। শান্ত পরিবেশ। প্রকৃতিও সেজেছে আপন রূপে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য পাহাড়ে ঘুরার এটাই উত্তম সময়। বৃষ্টিও নেই, নেই তাপদাহ। রয়েছে শীতের আমেজ। অবকাশ কাটানোর জন্য দূর-দূরান্ত থেকে আগত পর্যটকদের জন্য পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা রয়েছেন প্রস্তুত।
পার্বত্যাঞ্চল এমনিতেই প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্রে ভরপুর। তার মধ্যে পর্যটকদের জন্য পাহাড়ে গড়ে তুলা হয়েছে বেশকিছু পর্যটন কেন্দ্র।
জানা গেছে, সত্তর দশকের শেষদিকে রাঙামাটি জেলাকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। এরপর পর্যটকদের সুবিধার্থে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয় পর্যটন করপোরেশন। বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব সীমান্তে দেশের এক দশমাংশ জায়গা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল গঠিত। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ও বৈচিত্র্যে ভরপুর রাঙামাটি। এর পূর্বে ভারতের মিজোরাম রাজ্য, উত্তরে খাগড়াছড়ি ও দক্ষিণে বান্দরবান জেলা। রাঙামাটির আয়তন ৬ হাজার ৪৮১ বর্গকিলোমিটার। এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম লেক, দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র ও কর্ণফুলী পেপার মিল এই জেলায় অবস্থিত। এমনি আরও অনেক প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সম্মিলনে রাঙামাটি জেলা গবির্ত। এ অঞ্চলে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান ধর্মের ১১টি ভাষাভাষির ১৪টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে। পাহাড়ির-বাঙালি অসাম্প্রদায়িক মহামিলনের ঐকতানের কেন্দ্রবিন্দু পাহাড়ি জনপদ রাঙামাটি। এ অঞ্চলে প্রতিটি জনগোষ্ঠীরই রয়েছে নিজস্ব আচার অনুষ্ঠান, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যপূর্ণ সামাজিকতা। রাঙামাটির মূল শহর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের হলিডে কমপ্লেক্স। পর্যটন এলাকায় দৃশ্যমান হ্রদের বিস্তৃত জলরাশি ও দূরে উঁচ-নীচু পাহাড়ের সারি তৈরি করেছে চমৎকার এক নৈসর্গিক আবেশ। ১৯৭৮ সালে পর্যটন করপোরেশন মূল মোটেলটি এবং ১৯৮৬ সালে আধুনিক অডিটোরিয়াম ও দু’টি পাহাড়ের সংযোগ দেয়া কাপ্তাই হ্রদের ওপর ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ করা হয়। ৩৩৫ ফুট দীর্ঘ মনোরম ঝুলন্ত সেতুটি পর্যটন কমপ্লেক্সের গুরুত্ব ও আকর্ষণ অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পাহাড়ের বুক চিরে প্রবহমান স্বচ্ছ জলধারা সবুজ প্রাণের ছোঁয়া এ জেলাকে করেছে বৈচিত্র্যপূর্ণ। হ্রদ পাহাড়, ঝর্ণা অপরূপ অরণ্য আর কোলাহলমুক্ত পার্বত্য জনপদ রাঙামাটি মানুষের হৃদয় মন্দিরে স্থান করে নিয়েছে বহু আগেই।
দেশের যে কোনো স্থান থেকে রাঙামাটিতে আসার জন্য সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা থেকে রাঙামাটি যেতে সরাসরি চালু রয়েছে সৌদিয়া, ইউনিক, বিআরটিসি, ডলফিন, এস. আলমসহ বিলাসবহুল বাস সার্ভিস। রয়েছে এসি বাসের সুবিধা। ঢাকার সায়েদাবাদ, কমলাপুর, ফকিরাপুল, মতিঝিল, কলাবাগান প্রতিদিন এমনকি রাতেও ছাড়ে বাসগুলো। চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া যায় খুব সহজে। চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৭৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পর্যটন শহর রাঙামাটি। চট্টগ্রাম শহর থেকে রাঙামাটি আসতে সময় লাগবে মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। চট্টগ্রামের মুরাদপুর’ বিশ্বরোডে আছে রাঙামাটির প্রধান বাস স্টেশন। যেখান থেকে ছাড়ে বিআরটিসি এবং বিরতিহীন বাস সার্ভিসসমূহ। সৌদিয়া, এস আলম ও পাহাড়িকা বাস পাওয়া যায় চট্টগ্রামের অক্সিজেন থেকেও।
বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম