১৪ আগস্ট, ২০২১ ১১:০১
শুভ উদ্যোগ

লালমনিরহাটে শুভসংঘের ‘প্রজেক্ট লকডাউন’

২৭ দিন দুস্থদের খাবার দেওয়া হয়েছে

হায়দার আলী বাবু

লালমনিরহাটে শুভসংঘের ‘প্রজেক্ট লকডাউন’

সামছুল হক। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তাঁর বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার একটি চরাঞ্চলে। এখন ঘরসংসার কিছুই নেই। আছে শুধু একটি ব্যাগ, ভেতরে নিজের কাফনের কাপড়। নদীভাঙনে নিঃস্ব মানুষটির ঠিকানা এখন লালমনিরহাট রেলওয়ে স্টেশন। মানুষের দয়ায় দিন চলে, রাত হলে ঘুমান প্ল্যাটফর্মে। শুরু হয় লকডাউন। বন্ধ হয় ট্রেন, দোকানপাট। সুনসান স্টেশনে বেকায়দায় পড়েন বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মানুষটি। তাঁর ক্ষুধার কষ্ট কিছুটা লাঘবে এগিয়ে আসে লালমনিরহাট শুভসংঘ। তুলে দেওয়া হয় রাতের খাবার। শুধু এক দিন নয়, ২৭ দিন। ‘যত দিন লকডাউন তত দিন খাবার’ প্রত্যয় নিয়ে শুরুটা হয়েছিল গত ২ জুলাই। এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ‘প্রজেক্ট লকডাউন’। আর সামছুল হক একা নন, তাঁর মতো আরো অনেকেই যুক্ত হয় এই তালিকায়। তাদের কারো ঘর-পরিজন কিছুই নেই। কেউ প্রতিবন্ধী, কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন। এসব মানুষের আশ্রয় রেলওয়ে স্টেশনে কিংবা শহরের বিভিন্ন সড়কে। মানুষের দয়ায় তাদের খাবার জুটত। তবে লকডাউনে তারা পড়ে চরম বিপাকে। এসব মানুষের দুঃসময়ে এগিয়ে আসে শুভসংঘ। আর এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সমাজের অনেকেই।

অপেক্ষা খাবারের

কঠোর লকডাউন চলাকালে বন্ধ ছিল দোকানপাট, ট্রেন-বাস। রেলওয়ে স্টেশন যেন বিরানভূমি। সেখানে ছিন্নমূল মানুষকে খাওয়াবে কে? ফলে ওই দিনগুলোতে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে তাদের জীবন। সারা দিন মিলে এপাশ-ওপাশ করে কারো ভাগ্যে জুটত একটা ছোট্ট পাউরুটি। হয়তো কোনো গলির দোকানে সকালের অবিক্রীত একটা শুকনো পরোটা মিলত দুপুরে। কেউ বা কিছুই না পেয়ে দিনমান উপোস। দিনটা যেভাবেই কাটুক ওই সময়টাতে তারা অপেক্ষায় থাকত রাতের। কারণ রাত হলেই তাদের কাছে পৌঁছে যেত শুভসংঘের খাবার। প্যাকেট পেয়েই খাওয়া শুরু, এরপর প্ল্যাটফর্মেই ঘুম। আবার সারা দিন অপেক্ষা পেটপুরে খাওয়ার।

 
রান্না হতো বাড়িতে

লকডাউনের কারণে অন্য কোথাও রান্নার সুযোগ ছিল না। তাই বেছে নেওয়া হয় লালমনিরহাট প্রেস ক্লাবের অফিস সহায়ক জুয়েল রানার বাড়ি। তাঁর বাড়িতে রান্না শেষে প্রেস ক্লাবে প্যাকেট করা হচ্ছিল। কিন্তু দুই দিনের মাথায় ঘটে বিপত্তি। জুয়েলের মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। ফলে দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন সাংবাদিক তন্ময় আহমেদ নয়ন ও অ্যাডভোকেট মলিনা ইয়াসমিন দম্পতি। বাকি দিনগুলো তাঁদের বাড়িতেই যত্নসহকারে রান্না ও প্যাকেট করে ছিন্নমূল মানুষের কাছে ছুটতেন শুভসংঘের এই দুই সক্রিয় সদস্য। প্রতিদিন সকালে ঠিক হতো মেন্যু, দুপুর থেকে শুরু হতো রান্নার প্রস্তুতি।

 

 
চেয়েছেন যা পেয়েছেন তা

শুরুটা করা হয়েছিল ডিম-খিচুড়ি দিয়ে। এতে অনাহারী মানুষগুলোর ক্ষুধা মিটত; কিন্তু তৃপ্তি পেত না। তাদের সাদা ভাত খেতে ইচ্ছা করত। শুভসংঘের বন্ধুরাও তাদের চাওয়াকে প্রাধান্য দেন। সপ্তাহে একদিন ডিম-খিচুড়ি ছাড়া বাকি ছয় দিন খাবারের তালিকায় ছিল সাদা ভাত। সঙ্গে গরু বা মুরগির মাংস, মাছ ও ডিম। এগুলোর সঙ্গে প্রতিদিন সবজি বা ডাল থাকত। এসব খেয়ে তারা পরিতৃপ্ত হতো। ঈদের আগে লকডাউন তুলে নেওয়া হলে ‘ঈদ স্পেশালের’ মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রথম পর্যায়ের কার্যক্রম। সেদিন অসহায় মানুষগুলোকে দেওয়া হয় গরুর মাংসের বিরিয়ানি, সঙ্গে ডিম, কোমল পানীয় ও মিষ্টি। মাঝেমধ্যে সরবরাহ করা হতো বোতলজাত বিশুদ্ধ পানি। 

 
‘অনেক বছর ইলিশ খাই না’

ছিন্নমূল মানুষগুলো যেদিন যেটা খেতে চায়, তা-ই রান্নার চেষ্টা করা হয়েছে সব সময়। আর কী খেতে ইচ্ছা করে—খাবার বিতরণের ২৬তম দিনে এমন প্রশ্নের জবাবে বেশ কয়েকজন বলেন, ‘অনেক বছর ইলিশ খাই না। শেষ দিন যদি এক টুকরো করে ইলিশ দিতেন।’ পরদিন রান্না হয় সরষে-ইলিশ। সঙ্গে ছিল ডিম ভুনা, সবজি ও সাদা ভাত।

 
 

ভাড়া নেননি রফিকুল

লালমনিরহাট প্রেস ক্লাবের পাশেই বাড়ি রফিকুলের। ভ্যানগাড়ি চালান, দিন আনেন দিন খান। তিনি প্রথম দিন থেকে যুক্ত হন এই কার্যক্রমে। চাল-ডাল নিয়ে যাওয়া, রান্না শেষে খাবারের প্যাকেট তুলে স্টেশন। সেখান থেকে শহরের অলিগলি। যখন প্রয়োজন তখনই হাজির হতেন। তাঁকে পারিশ্রমিক দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। রাজি হননি তিনি। বলেন, ‘আপনাদের এই ভালো কাজে আমি টাকা দিয়ে সহায়তা করতে পারব না। শ্রম দিয়ে সহায়তা করব।’
 

 

তৃপ্তির ঢেঁকুর

প্রায় ৪০ বছর ধরে স্টেশনে থাকেন ফাতেমা বেগম। নেই স্বামী-সংসার। প্রতিদিন তিনি শুভসংঘের দেওয়া খাবার খেয়েছেন। অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, ‘তোমগো মতোন কেউ এমন খাওয়া দেয় নাই। তোমাদের খাবার এত দিন ধরে মন ভরে শান্তি করে খাইছি।’ লকডাউনে খাবার না দিলে কী করতেন—এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘কষ্ট হইত। হয়তো ভাত পাইতাম; কিন্তু মাছ, মাংস, ডিমের মতো আয়োজনের খাবার পাইতাম না।’ একজন ফাতেমার কথায় উঠে আসে আরো অনেকের একই রকম অনুভূতি। যারা করোনাকালে, লকডাউনে অন্তত একবেলা পেটপুরে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে।


সহযোগিতা অনেকের

লকডাউনে যখন সবাই ঘরে ছিলেন তখন ‘যত দিন লকডাউন তত দিন খাবার’—অনেকটা চ্যালেঞ্জেরই ছিল। সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে লালমনিরহাট শুভসংঘ প্রতিটি দিন প্রাণপণ চেষ্টা করেছে ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে। আর শুভসংঘের এই চেষ্টাকে এগিয়ে নিতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন অনেকে। কেউ করেছেন অর্থ সহায়তা, কেউ কিনে দিয়েছেন ডিম, বিশুদ্ধ পানি বা কোমল পানীয়। একজন নিজের রেস্টুরেন্টে রান্না করে এক দিনের খাবার সরবরাহ করেছেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সফল হয়েছে কার্যক্রমটি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর