৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৩:৫৪

অবহেলায় বিপন্ন এক জমিদার বাড়ির গল্প

শেরপুর প্রতিনিধি

অবহেলায় বিপন্ন এক জমিদার বাড়ির গল্প

ব্রিটিশ জমিদার অধ্যুষিত এলাকা ছিল শেরপুর। তৎকালীন মোমেনশাহী জেলার মুক্তাগাছা জমিদারদের নিয়ন্ত্রণে শেরপুরের ষোল আনা জমিদারির গুরুত্বপূর্ণ ও সুদর্শন বাড়ি ছিল পৌনে তিন আনী জমিদার বাড়ি। জমিদাররা এখানে বসবাস করতেন এবং গড়ে তুলেছিলেন নয়নাভিরাম নানা কারুকাজ মণ্ডিত সুরম্য প্রাসাদ।

এই প্রাসাদের আঙিনায় ছিল খাজনা নেওয়ার কামরা, বৈঠকখানা, দরবার, রন্ধনশালা ও নৃত্যশালা। কালের বিবর্তনে গোটা জমিদার বাড়ির ইতিহাস ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। অযত্ন-অবহেলা আর ভগ্নদশা নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে কোন রকম ঠাই দাঁড়িয়ে আছে এই জমিদার বাড়ি।

জমিদার সত্যেন্দ্র মোহন চৌধুরী ও জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরীর মালিকানাধীন ছিল পৌনে তিন আনী জমিদার বাড়ি। ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে পৌনে তিন আনী জমিদারের বংশধর কিশোরী মোহন চেীধুরীর আমলে রং মহল, শীষমহলসহ নানা সৌধ নির্মাণ করা হয়। অপূর্ব কারুকার্য খচিত ভবনগুলোর মধ্যে উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত রং মহলের তিন অংশের প্রথম অংশ জমিদারদের খাস দরবার কক্ষ ও জলসাঘর।

দ্বিতীয় অংশে জমিদারদের খাস কামরা এবং তৃতীয় অংশে ছিল নায়েব-ম্যানেজারের কাচারি। গ্রিক স্থাপত্যের অনুকরণে স্থাপত্যটি নির্মাণ করা হয়েছিল। মূল ভবন রং মহলে রয়েছে সুপ্রশস্ত বেদী ও প্রবেশ দ্বারে রয়েছে অনেকগুলো ধাপ। প্রবেশদ্বারের দুই প্রান্তে রয়েছে অলঙ্কৃত স্তম্ভ। স্তম্ভগুলির নিচ থেকে উপর পর্যন্ত কারুকাজ খচিত নকশা। ভবনটিকে আকর্ষণীয় করে তুলতে কার্ণিশেও রয়েছে নানা নকশা। বাড়ির চার পাশের স্তম্ভগুলো চতুষ্কোণ বিশিষ্ঠ এবং বর্গাকৃতি কাঠামোর ব্যবহার লক্ষ্যনীয়। রং মহলের প্রবেশ পথে টালি আকৃতির ছোট-বড় প্লেটে শিল্পীর আঁকা দারুণ কারুকাজ আধুনিক শিল্পকে ছাড়িয়ে যায়। ছাদ গুলোকে আটকানো হয়েছে লোহার রেলিং দ্বারা আর ছাদ নির্মাণ হয়েছে চুন সুরকির ঢালাই দিয়ে। রং মহলের প্রবেশ পথে দুটি দরজা। ডানদিকের দরজা বরাবর টানা লম্বা করিডোর। করিডোর ও ভিতরের অর্ধেক দেয়াল জুড়ে বিরাজ করছে রঙিন চীনা পাথরের ফ্রেসকো ও ফুল লতাপাতার আঁকা টালি। রং মহলের ডানদিক ঘেঁষে শান বাঁধানো পুকুরের জলে পুরো রং মহলটি জলসাঘর প্রতিবিম্বিত হয়। আছে শীষমহল নামে আরেকটি প্রাসাদ। এই শীষমহলে জমিদাররা স্ত্রী পুত্র নিয়ে রাত কাটাতেন। এই বাড়িটি নির্মাণের পর জমিদার পরিবারের পূজা আর্চনার জন্য কূল দেবতা অন্নপূর্ণা গোপীনাথ মন্দির নির্মাণ করেন। যার মাঝে রয়েছে প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও হিন্দু স্থাপত্যরীতির অপূর্ব সমন্বয়। ওই দেবতার নামে এখনও পূজা আর্চণা হয়। শীষমহলটি এখন অস্তিত্ব সংকটে। শীষমহল সংলগ্ন রান্নাশালা এখনও আছে, যেখানে এখন কীটপতঙ্গের বসবাস। এই জমিদার বাড়ির জুড়ে শান বাঁধানো টলটলে জলের ছয়টি পুকুর আছে। তবে শান বাঁধানো ঘাটগুলো বিলীনের পথে। পুকুরের জল ধারা ময়লাযুক্ত।

জানা গেছে, শেরপুরের জমিদারদের মধ্যে পৌনে তিন আনী জমিদার পরিবার শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা ছিলেন। জ্ঞান বিজ্ঞান সাহিত্য চর্চাও ছিল লক্ষ্যনীয়। এসব চর্চার জন্য ‘জয় কিশোর’ নামে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। লাইব্রেরিতে ছিল পাঁচ সহস্রাধিক বই। অধিকাংশই ছিল বিজ্ঞান ও সাহিত্য বিষয়ক। জমিদার বাড়িটিকে কৃষি প্রশিক্ষাণালয়ে রূপান্তরিত করা হলে লাইব্রেরি ভবনটি আশির দশকে ভেঙে সেখানে টিনশেডের শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করা হয়। অমূল্য বই গুলোর কোন খোঁজ নেই।

রং মহলটি এক সময় কৃষি প্রশিক্ষাণালয়ের প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহার হলেও এখন তা আর ব্যবহার হচ্ছে না। ভবনগুলো এতোই জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে যে, সামান্য বৃষ্টিতেই এর ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে। স্থানে স্থানে সুরকির গাঁথুনি নড়বড়ে। পলেস্তারা খসে পড়ে যখন তখন। দৃষ্টি নন্দন দরজা জানালার কিছু ধ্বংবাশেষ এখনও আছে। এককালের দৃষ্টিনন্দন রং মহল, শীষমহল ও অন্যান্য স্থাপত্যগুলোর প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার কখনও হয়নি। এমনকি বাড়িটির দেয়ালেও গাছ লতাপাতায় ভরে গেছে। তাও পরিষ্কার করা হয় না।

কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ মো. সাইফুল আজম খান বলেন, ‘শেরপুর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ১৯৫৭ সালে জমিদার বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। জমিদারের সম্পত্তি ও স্থাপনা এখনো অক্ষত অবস্থায় আছে। এটা শেরপুরের মানুষের জন্য গর্বের একটি ইতিহাস। এই স্থাপনাগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার জন্য এটিআই শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় সার্বিকভাবে উন্নয়ন করার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারন করবো।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর