১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১১:৪৪

দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর গোলাপ গ্রাম

নাজমুল হুদা ,সাভার

 দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর গোলাপ গ্রাম

গ্রামের বুক চিরে চলে গেছে আঁকাবাঁকা পথ। দুপাশে গোলাপের বিস্তীর্ণ বাগান। তাই তো সাভার উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নের শ্যামপুর, সাদুল্লাহপুর, মৈস্তাপাড়া,বাগ্নিবাড়ি, বাটুলিয়া, কমলাপুর ও আরাবাগ এখন ‘গোলাপ গ্রাম’ নামেই সমধিক পরিচিত। অবশ্য গোলাপের মাঝেমধ্যে কিছু গ্লাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকা, জিপসি ও জারাবেরার বাগানও রয়েছে এসব গ্রামে। 

বসন্ত উৎসব ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে সব ধরনের ফুলের প্রধান গন্তব্য ঢাকা। সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিরুলিয়ার গ্রামগুলোতে ৪৫০ হেক্টর জমিতে গোলাপের চাষ হয়েছে। আর গোলাপ চাষে যুক্ত আছেন প্রায় তিন হাজার কৃষক। গোলাপ বিক্রির জন্য শ্যামপুর ও মৈস্তাপাড়ায় গড়ে উঠেছে ফুলের বাজার। 

চাষিরা বাগান থেকে ফুল তুলে বিকেলের মধ্যেই বাজারে নিয়ে যান। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চলে ফুল বেচাকেনা। স্থানীয় ফড়িয়ারা দুই বাজার থেকে ফুল কিনে সরাসরি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রি করেন। গাজীপুর এলাকার থেকে বেড়াতে এসেছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মৌ খন্দকার। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সময় পেলেই এখানে ঘুরতে চলে আসি। ঢাকার এত কাছে এত সুন্দর গ্রাম ভালোই লাগে। ঘাটে নেমে হেঁটে হেঁটে কয়েক গ্রাম ঘুরে দেখি। 

বিকেলে ফুলচাষিরা ফুল কেটে নিয়ে চলে আসেন হাটে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা এসে ভিড় জমান। রাতে জমে বেচাকেনা। ভোর হওয়ার আগেই গোলাপ গ্রামের ফুল পৌঁছে যায় রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা ফুল বিক্রির দোকানে। সাদুল্লাহপুর ঘাটে বেশ কিছু দোকানপাট আছে। দুটি খাবার হোটেল আছে মোটামুটি মানের। সেখানে ভাত, ভর্তা, সবজি, ছোট মাছ ইত্যাদি পাওয়া যায়। ঘাটের মিষ্টির দোকান দই, মিষ্টিসহ গরুর দুধের চা পাওয়া যায়। গ্রামে ঘোরা শেষে অনেকেই মুঠো ভরে তাজা গোলাপ কেনেন। গোলাপ গ্রামের কিছুটা সৌরভমাখা স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসেন কর্মব্যস্ত শহরে জীবনে। যারা প্রকৃতির সান্নিধ্য ভালোবাসেন, যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তি দূর করতে একটু সময় বের করে ঘুরে আসতে পারেন লাল গোলাপের গ্রামে।

গোলাপের সৌন্দর্য দেখতে অনেকেই দল বেঁধে চলে আসেন বিরুলিয়াতে। খলিলুর রহমান পরিবারের গোলাপবাগানে বেড়াতে এসেছিলেন। ঘুরে দেখতে দেখতে একসময় নেমে যান ফুল তুলতে। নিজের হাতে বাগান থেকে ফুল তুলতে পেরে বেশ উচ্ছ্বসিত তিনি। খলিলুর রহমান বলেন, ‘ঢাকার কাছেই এমন ফুলের বাগানের কথা শুনে দেখতে এসেছিলাম। সত্যিই অসাধারণ। লাল টকটকে গোলাপ মাথা উঁচিয়ে থাকে। দুপুরের পর থেকেই চাষিরা বাগানে নেমে যান গোলাপ তুলতে। গাছের সারির এক পাশ থেকে ফুল তোলা শুরু করে শেষ পর্যন্ত মুঠো ভরে ফুল তোলেন চাষিরা, ফুল তোলার দৃশ্যও বেশ উপভোগ্য।’ 

গোলাপচাষি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সারা বছরই গোলাপ চাষ হয়। এখানে মূলত মিরান্ডা প্রজাতির লাল গোলাপের চাষ হয়। অনেকেই গোলাপ বাগান দেখতে আসেন। যারাই ঘুরতে আসেন, কিছু টাকার ফুল কিনে নিয়ে যান।’

ট্রলারে সাদুল্লাহপুর যেতে চাইলে গাবতলী মাজার রোড কিংবা মিরপুর ১ নম্বর গোলচত্বর নেমে রিকশায় দিয়াবাড়ি বটতলা ঘাট যেতে হবে। ঘাট থেকে ৩০ মিনিট পরপর সাদুল্লাহপুরের উদ্দেশে ট্রলার ছাড়ে। জনপ্রতি ভাড়া ২০ টাকা। হেঁটেই সাদুল্লাহপুর ও এর আশপাশের গ্রাম ঘোরা যায়। বিরুলিয়ার এলাকার জারবেরা ফুলের চাষি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে সুলতান বলেন, ‘ফুলের বাজার সবচেয়ে ভালো যায় আগস্ট থেকে মার্চ পর্যন্ত আট মাস।’ আরেক কৃষক মোক্তার হোসেন বলেন, ‘পয়লা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি ও ২৬ মার্চ এসব দিবসেই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এসব উৎসবের সময় প্রতিটি গোলাপ পাঁচ থেকে আট টাকায় বিক্রি হয়। এপ্রিল-জুলাই চার মাসে প্রতিটি গোলাপ বিক্রি হয় ২টাকা ৫০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৪ টাকায়।’

চাষিরা আরও জানান, গোলাপের চাহিদা ও দাম কমে যাওয়ার কারণে তারা অনেকেই ইতিমধ্যে গ্লাডিওলাস, জারবেরাসহ অন্যান্য ফুলের আবাদ শুরু করেছেন। সাভারের ফুল ব্যবসায়ী নেতা ও ভবানীপুরের জারবেরা ফুলবাগানে মালিক বশির আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আগে গোলাপের আবাদ করলেও এবার আরাবাগে ১২ বিঘা জমিতে জারবেরা চাষ করেছেন। ১২ বিঘা জমি থেকে প্রতি মাসে ১০-১৫ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে আশা তার।

সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজিয়াত আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শীত-বৃষ্টির পাশাপাশি ছত্রাকের আক্রমণে গাছ মাটি থেকে খাবার নিতে পারছে না। আমরা ওষুধ দিয়েছি, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। বিষয়টি দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করছি।’

বিরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম মণ্ডল বলেন, ‘এক হাজার ইউনিয়নে দুই হাজার ফুলচাষি রয়েছেন। সারা বছর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চাষিরা মাত্র তিন থেকে চার মাস ফুলের ন্যায্যমূল্য পান। অন্য দিনগুলোতে তাদের পানির দামে ফুল বিক্রি করে দিতে হয়। এ অবস্থার অবসান জরুরি।’ 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যশোর জেলার ঝিকরগাছার একটি সাধারণ গ্রাম গদখালী। ফুলচাষিদের হাত ধরে সেই গ্রামে পরিচিতি এখন দেশজুড়ে। তেমনি আমার নির্বাচনী এলাকার ফুলচাষিদের হাত ধরে গোলাপ গ্রাম এখন পরিচিতি পেয়েছে দর্শনীয় স্থানে। এর কৃতিত্ব আমার ফুলচাষি ভাই বোনদের। গোলাপের সৌরভ আর সৌন্দর্যের টানে দূর-দূরান্ত থেকে লাখ লাখ পর্যটন ছুটে আসেন এই গ্রামে। কিন্তু গত ২ বছর মহামারি করোনার ছোবলে শান্তি এবং স্বস্তি কেড়ে নিয়েছিল সাভারে ফুলচাষিদের।

 

বিডি প্রতিদিন/নাজমুল

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর