শিরোনাম
৫ এপ্রিল, ২০২৩ ২১:৪৬

কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিতে সাদা সেমাই পল্লীতে নেই ব্যস্ততা

আবদুর রহমান টুলু ,বগুড়া

কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিতে সাদা সেমাই পল্লীতে নেই ব্যস্ততা

ছবি- বাংলাদেশ প্রতিদিন।

দেশজুড়ে কদর থাকলেও বগুড়ায় তৈরি সাদা চিকন সেমাই পল্লীতে ব্যবসায়ীদের ভালো দিন যাচ্ছে না। সাদা সেমাই তৈরির কাঁচামাল, শ্রমিক মজুরী, বিদ্যুৎ বিল, পরিবহন খরচসহ অন্যন্য উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় লড়াই করেও টিকতে পারছে না সাদা সেমাই ব্যবসায়ীরা। কাঁচামালের বৃদ্ধির কারণে টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় অর্ধশত সেমাই কারখানা। আর ব্যস্ততা কমেছে সেমাই পল্লীতে।

জানা যায়, স্বাধীনতার আগে ও পরে বগুড়ায় নিয়মিতভাবে সাদা চিকন সেমাই তৈরি হয়ে আসছে। জেলার শাজাহানপুর উপজেলার বেশ কিছু গ্রামে এই সাদা সেমাই তৈরি হয়ে থাকে। দীর্ঘকাল থেকে সাদা সেমাই তৈরি করে আসায় সেমাই পল্লী হিসেবে বলা হয়ে থাকে গ্রামগুলোকে। শাজাহানপুর উপজেলার সেমাইপল্লী খ্যাত মাদলা, বেজোড়া, ঢাকন্তা, শ্যাওলাকাথিপাড়া, কালসিমাটি, রবিবাড়িয়াসহ প্রায় ২০টির মত গ্রামে সেমাই তৈরি হয়ে থাকে। সেমাই তৈরির সঙ্গে গ্রামের শত শত নারী-পুরুষ কাজ করে থাকে। বাড়তি আয়ের জন্য নারীদের অনেকেই যুক্ত হয়েছেন এ পেশায়। সময়ের ব্যবধানে এ সাদা সেমাই তৈরির শিল্প বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে এখানকার তৈরি চিকন সাদা সেমাইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তে। সারা বছরই কমবেশি সাদা সেমাই তৈরি করা হয় গ্রামগুলোতে। প্রত্যেক বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহায় রেকর্ড পরিমাণ সেমাই তৈরি করেন কারখানার মালিক-শ্রমিকরা। 

বগুড়ায় তৈরি এই সাদা সেমাই বিক্রি হয় ঢাকা, টাঙ্গাইল, সিলেট, চুয়াডাঙ্গা, রংপুর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, নীলফামারি, নওগাঁ, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, নাটোর, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ বিভিন্ন জেলায়। কিন্তু এবারে চিত্র ভিন্ন। সাদা সেমাই তৈরির কাঁচামালসহ অন্যান্য উপকরণের মূল্য বেশি হওয়ার কারণে প্রায় অর্ধশত কারখানা বন্ধ রয়েছে। কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ায় অনেক নারী শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। সংসারে বাড়তি আয়ের আশায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সেমাই কারখানার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতেন ওই গ্রামগুলোর নারী শ্রমিক। প্রতি বছর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে পাল্লা দিয়ে কাজ চলতো সেমাই পল্লীর কারিগরদের। দিনরাত তৈরি করতেন চিকন সাদা সেমাই। কর্পোরেট ব্যবসায়িদের দৌরাত্বে আর অটো মেশিনকারখানার কাছে  সেমাই পল্লীতে কর্মব্যস্ততায় এখন বেশ ভাটা পড়েছে। এর সঙ্গে কাঁচামাল এবং শ্রমিক মজুরী বেশি হওয়ায় তারা চাহিদামতো সাদা সেমাই তৈরি ও সরবরাহ করতে পারছেন না। লোকসান গুনতে গুনতে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এবছর সাদা সেমাই খ্যাত সেমাইপল্লীতে মাত্র কয়েকটি গ্রামে তৈরি হচ্ছে সাদা সেমাই। 

ঈদে প্রত্যেক কারখানায় গড়ে প্রতিদিন প্রায় পাঁচশত কেজির মতো ময়দা থেকে সাদা সেমাই তৈরি করা হতো। যার পরিমাণ প্রায় বিশ খাঁচি। চাহিদা বেড়ে গেলে হয়তো আরো বেশি সেমাই তৈরি করা হতো। সে তুলনায় এবার হাতে গনা কয়েকটি কারখানায় গড়ে প্রতিদিন ১৫০-২০০ কেজির মতো ময়দা থেকে সাদা সেমাই তৈরি করা হচ্ছে। ময়দার দাম বেড়ে যাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। আগের মত আর লাভের মুখ দেখা যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে এই ব্যবসা অনেকই ছেড়ে দিয়েছেন। 

শাজাহারপুর উপজেলার শ্যাওলাকাথিপাড়ার সেমাই কারখানার মালিক সাহেরা ও আব্দুর রশিদ জানান, ঈদের আগে সাদা সেমাইয়ের প্রচুর চাহিদা বেড়ে যায়। এসময় উৎপাদনও বেড়ে যায়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসেন সাদা সেমাই নিতে। প্রচুর চাহিদা থাকলেও এবছর কাঁচামালসহ শ্রমিক মজুরী বেড়ে যাওয়া উৎপাদন কম হচ্ছে। এই এলাকার অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। খরচ বেড়ে যাওয়ায় লাভের পরিমান অনেক কম। বাপ-দাদার ব্যবসা যার কারণে লোকসান হলেও ছাড়তে পারছিনা। এবছর প্রতি বস্তা (৩৭) কেজি ময়দার দাম বেড়ে ২ হাজার ৬০ টাকা থেকে ২ হাজার ১০০ টাকা হয়েছে। গত বছর ছিল ১ হাজার ৭০০ টাকা। এর আগের বছর ময়দার দাম ছিল ৯০০ টাকা। একই সাথে অন্যান্য পণ্যের সাথে শ্রমিক মজুরী বেড়ে গেছে। একজন শ্রমিকের মজুরী দিতে হচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০টাকা। সবমিলিয়ে এবছর সাদা সেমাইয়ের ব্যবসা অনেকাট মন্দাভাব। দিনে ৩ থেকে ৪ বস্তা ময়দার সাদা সেমাই তৈরি করা যায়। আর এতে প্রায় ৪ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। 

ব্যবাসায়ী শিউলী বেগম জানান, চাহিদা অনুযায়ী আমরা সেমাই তৈরি করতে পারছি না। এরমধ্যে ময়দার দাম বেড়ে যাওয়া আর্থিকভাবে লগ্নি করতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। গত বছর প্রতি বস্তা ময়দার দাম ছিল ১ হাজার ৭০০ টাকা। এবছর বস্তা প্রতি ময়দার দাম বেড়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। ১ বস্তায় (৩৭ কেজি) সাদা সেমাই তৈরি হয় প্রায় ৩৪ কেজি। এর সাথে বিদ্যুৎ এর দাম ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। গত বছর প্রতি খাঁচি (২৫ কেজি) ১ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এবার সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতি খাঁচি ১ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে প্রতি কেজির দাম হচ্ছে ৭৬ টাকা থেকে ৮০টাকা। 

তিনি আরও জানান, তাদের তৈরি সাদা সেমাই দেশজুড়ে খ্যাত। দেশের বিভিন্ন জেলা যেমন- ঢাকা, সৈয়দপুর, দিনাজপুর, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা থেকে পাইকার এসে এসব সাদা সেমাই নিয়ে যায়। তবে চুয়াডাঙ্গা জেলার ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি পরিমান এই সেমাই ক্রয় করে নিয়ে যায়।

এদিকে বগুড়ার বেশ কয়েকটি কর্পোরেট কারখানা সূত্রে জানা যায়, সাদা সেমাই অটো মেশিনে তৈরি করে প্যাকেটজাত করে মার্কেটিং করছে। প্রতি কেজি তারা সাদা সেমাই বিক্রি করছেন ১৫০ টাকা কেজি। 

নারী শ্রমিক আছিয়া খাতুন জানান, কারখানায় তাদের পারিশ্রমিক আসে সেমাই তৈরির উপর। এক বস্তা (৩৭ কেজি) ময়দার সেমাই বানিয়ে তারা পারিশ্রমিক পান ২০০ টাকা। দিনে ৩ থেকে ৪ বস্তা ময়দার সেমাই তৈরি করা যায়। 

ঢাকন্তা এলাকার ব্যবসায়ী ইয়াছিন মোল্লা জানান, এ এলাকার অনেক কারখারার মতো তার কারখানাতেও কাজ করতেন ১০-১২ জন নারী শ্রমিক। কিন্তু এ বছর ময়দার দাম আর শ্রমিক মজুরী বেড়ে যাওয়া তার কারখানা বন্ধ রয়েছে।  


বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর