৩ মে, ২০২৩ ২২:০১

জীবিকা নির্বাহে রিক্সা চালান জনপ্রতিনিধি মাইকেল ঢালী!

রোকনুজ্জামান পারভেজ , শরীয়তপুর

জীবিকা নির্বাহে রিক্সা চালান জনপ্রতিনিধি মাইকেল ঢালী!

৪৪ বছর বয়সী মাইকেল ঢালী। এলাকায় রিক্সাওয়ালা নিউ মাইকেল নামেই পরিচিত। তিনি একটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচিত সদস্য। জীবিকার তাগিদে ১৬ বছর ধরে গ্রামের রাস্তায় রিক্সা চালাচ্ছেন।

মাইকেলের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার পোরাগাছা গ্রামে। তিনি ওই উপজেলার মোক্তারেরচর ইউপির ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য। গত বছর জানুয়ারিতে ইউপি নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছেন। ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরও জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম রিক্সা চালানো ছাড়েননি। রিক্সা নিয়েই মানুষের বাড়িতে যান।  দুঃখ-কষ্টের কথা শোনেন। সাধ্যমত তাদের পাশে দাঁড়ান। দরিদ্র মানুষদের সরকারের নানা প্রকল্পের সুবিধা পেতে করছেন সহযোগিতা। 

গ্রামবাসীরা জানান, নড়িয়ার মোক্তারেরচর ইউপির পোরাগাছা গ্রামের মৃত আব্দুর রব ঢালী ও নীলুফা বেগম দম্পতির ছেলে মাইকেল। ৮ ভাই-বোনের মধ্যে মেজ মাইকেল। কিশোর বয়সেই বাবা-মা মারা যান। জীবিকার তাগিদে ঢাকায় গিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা চালানোর কাজ শুরু করেন। ১০ বছর নৌকা চালিয়ে ফিরে আসেন গ্রামে। রিক্সা চালানো শুরু করেন।

রিক্সা নিয়ে গ্রামের মানুষকে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে আনা-নেয়া করতে গিয়ে দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। জড়িয়ে পরেন তাদের নানান সুখ-দুঃখের সাথে। 

নির্বাচিত হয়ে ভোটের সময় দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখেন না অনেক জনপ্রতিনিধি। সরকারের নানা প্রকল্প থেকে অসহায় মানুষদের বঞ্চিত করা হয়। এমন দেখে মনে কষ্ট হয় দরিদ্র রিক্সা চালক মাইকেলের। গরিব মানুষের ন্যায্য অধিকার পাইয়ে দিতে মনে বাসনা জাগে। ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কয়েক ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। থেমে থাকেন না মাইকেল। গত বছর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে আবার ভোটে দাঁড়ান। এবার ভোটাররা তাকে সুযোগ দেন। নির্বাচিত হয়ে দরিদ্র মানুষের অধিকারের কথা বলতে ইউনিয়ন পরিষদে যান।

মোক্তারেরচর ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র জানায়, গত বছর জানুয়ারিতে নির্বাচনের পর মার্চে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শপথ পড়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাইকেল গত এক বছরে তার নির্বাচনী এলাকার (৬ নম্বর ওয়ার্ড) বিভিন্ন মানুষকে নানা ধরনের সরকারি সহায়তা পাইয়ে দিয়েছেন।

৩০ জনকে টিসিবির  ফ্যামেলি কার্ড, ১০ জনকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, ৮ জনকে ভিজিডি, ২৫ জনকে বিশেষ খাদ্য সহায়তা, ১৫ জনকে বয়স্ক ভাতা, ২ জনকে বিধবা ভাতা, ২ জনকে গর্ভবতী ভাতা ও একজনকে প্রতিবন্ধী ভাতা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।  এ ছাড়া সরকারি প্রকল্পে ওই ওয়ার্ডে তিনটি মাটির রাস্তা নির্মাণ করছেন। যার দৈর্ঘ্য ৬ কিলোমিটার। 

দারিদ্র্যেের কারণের পড়া-লেখা করতে পারেননি মাইকেল। তাইতো এক মেয়ে ও এক ছেলেকে রিক্সা চালানোর আয়ে পড়া-লেখা করাচ্ছেন। তার কোন কৃষি জমি নেই। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া দুই শতাংশ জমিতে একটি বসত ঘর রয়েছে। রিক্সা চালানোর ৫০০-৬০০ টাকা আয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তাই স্ত্রী লিপি বেগম হাস, মুরগি ও গবাদি পশু পালন করে কিছু আয় করেন।

মাইকেলের স্ত্রী লিপি বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমার স্বামীর শিক্ষা-দীক্ষা ও টাকা-পয়সা নেই। কিন্তু তার মহৎ একটি হৃদয় আছে। আমাদের মত দরিদ্র মানুষ যারা তাদের সেবা করার জন্যই ইউপি সদস্য হয়েছেন। সমাজ সেবা করতে গিয়ে তাকে সময় নষ্ট করতে হয়। ওই সময়ে কাজ করলে আরো আয় হত, সংসার চালাতে সুবিধা হত। তাতে আমাদের কোন আক্ষেপ নেই। মানুষ ভরসা ও বিশ্বাস করে তাদের মূল্যবান ভোট দিয়েছেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি আমার স্বামী যেন মানুষের ভোটের মর্যাদা রাখতে পারেন। 

পোরাগাছা গ্রামের আলমগীর ঢালী বাকপ্রতিবন্ধী। অভাবের সংসার। কেউ তাকে সহায়তা করছিল না। মাইকেল নির্বাচিত হওয়ার পর আলমগীরের পরিবারকে খাদ্যসহায়তার ভিজিডি কার্ড দিয়েছেন।

আলমগীরের স্ত্রী ফুল মালা বলেন, আমরা অনেক গরিব মানুষ। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সহায়তা পাচ্ছিলাম না। মাইকেল ভাই নির্বাচিত হওয়ার পর আমরা প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল পাচ্ছি। তিনি গরিব মানুষের জন্য কাজ করছেন।

পোরাগাছা গ্রামের লোকরি মাদবর বয়স্ক ভাতা পেতেন না। ইউপি সদস্য মাইকেল তার কাগজপত্র নিয়ে সমাজ সেবা কার্যালয়ে জমা দিলে বয়স্ক ভাতা পেতে শুরু করেন। 

পোরাগাছা গ্রামের লোকরি মাদবর বলেন, আমরা গরিব মানুষ। চেয়ারম্যান মেম্বাররা আমাদের পাত্তা দিতে চায় না। কিন্তু আমাদের গরিবের বন্ধু রিক্সাওয়ালা মাইকেল আমাদের কষ্ট বোঝে। তাইতো বয়স্ক ভাতা পেয়েছি।

ইউপি সদস্য মাইকেল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি গরিব মানুষ। যাত্রী নিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে যাই। তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা শুনি। গরিবদের সাথে মানুষ কিভাবে প্রতারণা করে, তাদের বঞ্চিত করে তা দেখে বড় হয়েছি। আমার মনে হয়েছে আমি মেম্বার হলে বঞ্চিত মানুষের উপকার হবে। তাই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেই। মানুষও আমাকে বিশ্বাস করেছেন। চেষ্টা করছি সাধ্যমত তাদের পাশে থাকতে। জনপ্রতিনিধি হয়েছি, মানুষের অধিকার আদায়ে পাশে থাকছি। কিন্তু নিজের পরিবারকেওতো বাঁচাতে হবে। তাই আয় করার জন্য রিক্সা চালাই। রিক্সা চালানো ছেড়ে দিলে সংসার চলবে কিভাবে? 

মোক্তারেরচর ইউপি চেয়ারম্যান বাদশা শেখ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দ অনুযায়ী ৬ নম্বর ওয়ার্ডে যা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে বিতরণ করছেন মাইকেল। মাইকেলের কার্যক্রমে ওই ওয়ার্ডের মানুষ সন্তুষ্ট। সে খুব তৎপর। রিক্সা নিয়ে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষের খোঁজ নেন, আমাদের জানান। আমরা তাকে নিয়ে গ্রামের মানুষের সমস্যা সমাধান করছি।

জানতে চাইলে নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শংকর চন্দ্র বৈদ্য বলেন, সমাজের টাকাওয়ালা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জনপ্রতিনিধি হন। দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষের জনপ্রতিনিধি হওয়ার নজির কম। মাইকেল ইউপি সদস্য হওয়ার পরও তার জীবিকার মাধ্যম রিক্সা চালানো ছাড়েননি। তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খুবই ভাল ধারণা পেয়েছি। এলাকার সাধারণ মানুষ তাকে খুবই ভালোবাসে। তিনি বর্তমান সমাজের এক বড় দৃষ্টান্ত। স্থানীয প্রশাসন সকল ভাল কাজে তার পাশে থাকবে।

 

বিডি প্রতিদিন/নাজমুল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর