১৩ জুলাই, ২০২৩ ০৮:৩৮
রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও

শত বছরের ঐতিহ্যবাহী নওগাঁর প্যারা সন্দেশ

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

শত বছরের ঐতিহ্যবাহী নওগাঁর প্যারা সন্দেশ

ছবি- বাংলাদেশ প্রতিদিন।

শত বছরের ঐতিহ্যবাহী নওগাঁর প্যারা সন্দেশ। বাঙালির রসনা তৃপ্তির অনন্য উপকরণ এ মিষ্টান্ন। অতুলনীয় স্বাদ ও গন্ধের জন্য সারা দেশে এর ব্যাপক সুনাম। শুধু দেশেই নয়, এর সুখ্যাতি ছড়িয়েছে বিদেশেও। ভারত, সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশেও যাচ্ছে এ মিষ্টান্ন। 

প্যারা সন্দেশের কারিগররা জানান, পোড়ানো ইটের মতো রং আর কড়া মিষ্টির আবরণে এর ভিতরে-বাইরে একই স্বাদ। এ সন্দেশ আকারে ২-৩ ইঞ্চি লম্বা। ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক পরিচিতি ছিল এ মিষ্টান্নের। এ সন্দেশ কে বা কারা প্রথম তৈরি করেন তা সঠিক কেউ বলতে পারেন না। 

অনেকের ধারণা, অনেকটা বংশপরম্পরায় কারিগররা এ মিষ্টান্ন তৈরি করে আসছেন। কথিত আছে, শত বছর আগে নওগাঁ শহরের কালীতলার শ্রীশ্রীবুড়ি কালীমাতা মন্দিরে ভোগের প্রয়োজনে এর পাশে দোকানে এ প্যারা সন্দেশ তৈরি শুরু হয়। পূজারিরা বিভিন্ন পূজামন্ডপে দেবদেবীর উপাসনার জন্য এ সন্দেশ মন্দিরে ভোগ দিতেন। এখনো এর  প্রচলন রয়েছে। ৪৭০-৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় এ সন্দেশ। 

আরও জনশ্রুতি আছে, ভারতের বিহারের কোনো এক নবাবের মিষ্টি তৈরির কারিগর ছিলেন মহেন্দ্রি দাস। নবাব এক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হওয়ার পর মহেন্দ্রি দাস জীবন বাঁচাতে নওগাঁ শহরের কালীতলায় এসে বসবাস শুরু করেন। জীবিকার তাগিদে তিনি প্যারা সন্দেশ তৈরি করে মন্দিরে মন্দিরে বিক্রি করতেন। পরে বাড়ির পাশেই ছোট্ট একটি মিষ্টির দোকান খুলে বসেন। তখন কালীতলায় জনবসতি ছিল না বললেই চলে। মহেন্দ্রির পর তার ছেলে ধীরেন্দ্রনাথ দাস দোকানের দায়িত্ব পান। সে সময় বিমল মহন্ত নামে মিষ্টির এক কারিগরের হাতে তৈরি প্যারা সন্দেশের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। 

ধীরেন্দ্রনাথ দাস প্রায় ৩০ বছর ব্যবসার পর দোকানটি সুরেশ চন্দ্র মহন্তের কাছে বিক্রি করে অন্যত্র চলে যান। এরপর সুরেশ চন্দ্র মহন্ত দোকানে নারায়ণ চন্দ্র নামে একজনকে মিষ্টির কারিগর হিসেবে আনেন। এরপর ওই দোকানের মালিকানা আবারও পরিবর্তন হয়। দোকানের বর্তমান মালিক বৈদ্য রতন দাস। তিনিই এখন প্যারা সন্দেশ তৈরি করেন। 

শ্রীশ্রীবুড়ি কালীমাতা মন্দিরের প্রধান গেটসংলগ্ন স্থানে ‘মা নওগাঁ প্যারা সন্দেশ’-এর দোকান। কালীতলা মহল্লার বাসিন্দা ফটিক চন্দ্র বসাক বলেন, নওগাঁয় বেশ কয়েকটি প্যারা সন্দেশের দোকান রয়েছে। দোকানগুলোর মালিকানা বিভিন্ন সময় পরিবর্তন হলেও সন্দেশের স্বাদ ও মান আছে আগের মতোই। 

শহরের ঘোষপাড়া মহল্লার বাসিন্দা চন্দ্রনা রানী ও কালীতলার বাসিন্দা কুমকুম শর্মা ও কৌশলী বলেন, দেবীর আরাধনায় ভোগের জন্য মিষ্টান্নের প্রয়োজন হয়।

কালীতলার বিখ্যাত মা নওগাঁ প্যারা সন্দেশের স্বত্বাধিকারী বৈদ্য রতন দাস বলেন, ‘মহেন্দ্রি দাস নামে এক ব্যক্তি প্রথমে প্যারা সন্দেশ তৈরি শুরু করেছিলেন। তখন কালীতলায় জনবসতি তেমন ছিল না। পর্যায়ক্রমে এখন আমি এ দোকানের মালিক। প্রায় ৩৬ বছর প্যারা সন্দেশের ব্যবসা করছি।’

বৈদ্য রতন দাসের ছেলে সৈকত দাস বলেন, আমরা বংশপরম্পরায় কালীতলায় বিখ্যাত প্যারা সন্দেশ তৈরি করে আসছি। নওগাঁয় এখন বেশ কয়েকজন প্যারা সন্দেশ তৈরি করলেও আমাদের দোকানের মিষ্টির ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে। প্রতিদিন আমাদের দোকানে ৬০ থেকে ৭০ কেজি প্যারা সন্দেশ তৈরি হয়। 
তবে পূজাসহ বিভিন্ন দিবসে আরও বেশি মিষ্টি তৈরি করা হয়। তিনি বলেন, ১ কেজি প্যারা সন্দেশ তৈরি করতে প্রায় ৪ লিটার তরল দুধের সঙ্গে ১ কেজি চিনি মেশানো হয়। প্রথম ধাপে তরল দুধের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় ক্ষীর। এ সময় অনবরত নাড়াচাড়া করতে হয়। একসময় ক্ষীর হাতায় জড়িয়ে আসে। এরপর চুলা থেকে তা নামানো হয়। হালকা গরম ক্ষীর দুই হাতে তালু দিয়ে রোল করে সামান্য চাপ দিলেই তৈরি হয়ে যায় প্যারা সন্দেশ।

নওগাঁর জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, নওগাঁর বিখ্যাত প্যারা সন্দেশ একটি প্রসিদ্ধ মিষ্টি। নওগাঁয় বেড়াতে এলে কেউ এ লোভনীয় ও সুস্বাদু প্যারা সন্দেশ নিয়ে যেতে ভোলেন না।

বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর