রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২ ০০:০০ টা

***********

একাত্তরের বর্বরতার জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার এটাই প্রকৃত সময় বলে উল্লেখ করল পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক এক্সপ্রেস ট্রিবিউন। কাল বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবসে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিকটি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছর নভেম্বরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইসলামাবাদের ডি-৮ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে ঢাকা সফরে গিয়েছিলেন। ওই সময় তাকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে। এর কূটনীতিসুলভ উত্তরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, 'উভয় দেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশের উচিত অতীত ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়া।' এর ফল খুব ভালো হলো না। কিছুদিন পর বাংলাদেশ জানিয়ে দেয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই সম্মেলনে যোগ দিতে পারছেন না। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, হয়তো মনে হতে পারে নতুন করে তোলা এই ক্ষমা প্রার্থনার দাবি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ। কিন্তু একটু গভীরে গেলেই আরও কিছু বিষয় চোখের পড়বে। আমলা থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ_ দেশটির সব পর্যায়ের মানুষেরই আজ একটাই অনুভূতি, সময় হয়েছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার। পররাষ্ট্রনীতির আওতাভুক্ত এ দাবি সরকারের উচ্চপর্যায়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল ২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন থেকেই। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান দূতাবাস কর্মকর্তা আলমগীর বাশার খান বাবরের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির বৈঠক হয়। এরপর থেকেই মূলত প্রসঙ্গটি নতুনভাবে উঠে আসে। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে চলতি সপ্তাহে দীপু মনি এঙ্প্রেস ট্রিবিউনকে বলেন, 'আমাদের দাবি কখনোই সাইড লাইনে চলে যায়নি। আমরা এ ইস্যুতে (পাকিস্তানকে) চাপে রাখব। আমাদের প্রত্যাশা, এক সময় পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকরা ক্ষমা চাইবেন।' এ ব্যাপারে (বাংলাদেশের) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশীয় বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, 'এখন থেকে প্রতিটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকেই সঠিক কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় আমরা এ ইস্যুতে পাকিস্তানকে চাপে রাখব।' তিনি বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে পত্র প্রেরণের কোনোই প্রয়োজন নেই। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের সুশীল সমাজ অনেক আগে থেকেই পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানিয়ে আসছে। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান (বর্তমান বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী) এক সমাবেশে বলেছিলেন, এটি (ক্ষমা প্রার্থনা) হলে উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন মনে করেন, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন ক্ষমা চাওয়াটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখন বাংলাদেশের অবস্থান আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। তিনি বলেন, 'অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক দিয়ে বাংলাদেশ এ অঞ্চলে অত্যন্ত গুরুত্ববহ একটি দেশ।' বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের প্রতি পাকিস্তানের আগ্রহের কথা উল্লেখ করে এই ইতিহাসবিদ বলেন, 'বাংলাদেশের পাকিস্তানকে যতটা প্রয়োজন, এর চেয়ে পাকিস্তানের অনেক বেশি প্রয়োজন বাংলাদেশকে।' বাংলাদেশের লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের মতে, এটি বাণিজ্যিক দাবির চেয়ে অনেক বেশি কিছু। হিনা রাব্বানির মন্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'তার জবাবে পাকিস্তানের উপেক্ষার কৌশলই ফুটে উঠেছে।' তার মতে, আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার অর্থ, একটা দেশ হিসেবে পাকিস্তানের ভুল কৌশলের দায় নেওয়া। তিনি উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের অধিবাসীদের জানা দরকার, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত কীভাবে সরকার ও সেনাবাহিনী দেশের পূর্বাংশে শোষণ-নির্যাতন চালিয়েছে। আর বিষয়টি যদি তারা জানতে পারে, তাহলে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য তারাও চাপ দেবে (তাদের সরকারকে)। স্বাধীনতার পর থেকেই অবশ্য আওয়ামী লীগ ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানিয়ে আসছে। এমনকি এ দাবি জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও। পাকিস্তান যেন ক্ষতিপূরণ দেয়, এ জন্য চাপ প্রয়োগে তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন অন্যান্য দেশকেও। যদিও ব্যক্তিগত কিছু স্বীকৃতি এসেছে। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ২০০২ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে একাত্তরের ঘটনার জন্য ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে এতে বাংলাদেশ সন্তুষ্ট ছিল না। তারা চেয়েছিল, আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করুক পাকিস্তান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ফরহাদ হোসেন বলেন, 'ক্ষমা চাইলে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, এটা পাকিস্তান জানে।' তিনি বলেন, 'আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যা দাবি করবে তা-ই দিতে বাধ্য পাকিস্তান। আর এটাই পাকিস্তানের বড় ভয়।' বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের মতে, বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনার ইস্যুটি সরাসরি সম্পৃক্ত। বর্তমানে দুই লাখেরও বেশি উর্দুভাষী মানুষ বাংলাদেশের ১০০টির মতো উদ্বাস্তু শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। স্বাধীনতার পর থেকে তাদের অনেককেই পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও এ পর্যন্ত পাকিস্তান ফিরিয়ে নিয়েছে অল্প কয়েকজনকে। ক্ষমা প্রার্থনার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ইতিবাচক পদক্ষেপের মাধ্যমেই এর সমাধান সম্ভব। তিনি বলেন, 'কিন্তু পাকিস্তান সরকার সমাধান চায় কি না, এটিই প্রশ্ন।'

সর্বশেষ খবর