রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২ ০০:০০ টা

তত্ত্বাবধায়ক দিয়ে গণতন্ত্রের চর্চা হবে না

আবদুল বাসেত মজুমদার

তত্ত্বাবধায়ক দিয়ে গণতন্ত্রের চর্চা হবে না
সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক ও বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের সভাপতি আবদুল বাসেত মজুমদার বলেছেন, দেশের বর্তমান রাজনীতি দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াত-শিবির ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের উদ্দেশে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে তা গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা বলেন। প্রবীণ এ আইনজীবী নেতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক প্রসঙ্গে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক দিয়ে গণতন্ত্রের চর্চা হবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দিয়েই আমাদের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। তিনি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এ অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে না পারলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখী-সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ অর্জন সম্ভব নয়। বিরুদ্ধ শক্তির বিভাজনের কারণে স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও আমরা সেটা অর্জন করতে পারিনি। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি আবদুল বাসেত মজুমদার সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে 'গরিবের আইনজীবী' হিসেবে পরিচিত। কেননা গরিব বিচারপ্রার্থীরা আবদুল বাসেত মজুমদারের কাছে গিয়ে আইনগত সহায়তা ছাড়া কখনোই ফেরেন না। উচ্চ আদালতে মামলা চালানোর সামর্থ্য নেই এমন অসংখ্য মানুষ শেষ অবলম্বন হিসেবে তার কাছেই সহায়তা চেয়ে থাকেন। তিনিও পরম আন্তরিকতায় অসহায় মানুষকে আইনি সহায়তা দেন। আর কুমিল্লায় বাড়ি হলে তো কোনো কথাই নেই। আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, যে কোনো মূল্যে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কুফল আমরা দেখেছি। আমাদের গণতান্ত্রিক দেশ, গণতন্ত্র চর্চার ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। সব দলকেই গণতন্ত্র চর্চা করতে হবে। অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই। অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের মধ্যে গোড়াতেই গলদ ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধ নিয়ে যে বিভাজন ছিল, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল সেই অপশক্তি এত বছরেও নিজেদের বদলাতে পারেনি। যদিও অনেকে বলেন, স্বাধীনতার বিরোধী এখন আর কেউ নেই। কিন্তু চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধীদের কাজে-কর্মে সেটির প্রমাণ নেই। তারা একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারেনি। স্বাধীন দেশকে মেনে নিতে পারেনি। তারা একাত্তরের ভুল স্বীকার করে এ দেশের মানুষের সঙ্গে সহাবস্থানে আসতে পারেনি। আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, '৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসিত করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের উৎসাহিত করেন এবং আইন করে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করেন। এর পর দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে আইন সংশোধন করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের আওতায় আনেন। কয়েকজন খুনিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন ঘৃণিত খুনি দেশে দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতিরা '৭১-এ যা করেছে, তা থেকে আজও বিচ্যুত হয়নি। আজ জামায়াত-শিবির ও খালেদা জিয়া মিলে একটা শক্তি অর্জন করেছে। যার ফলে ২০০১ সালে ক্ষমতায় গিয়ে তারা স্বাধীনতার পক্ষশক্তি দমনের সর্বাত্দক চেষ্টা চালায়। এ সময় জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে খালেদা জিয়াও জামায়াত নেতাদের স্বাধীন দেশের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেন। এই দুঃসময় চলে ২০০৬ পর্যন্ত। মাঝখানে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক শাসন পেরিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল গণরায় নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফেরেন শেখ হাসিনা। এবার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। সেই দায়বদ্ধতা থেকে বাঁচতেই তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে হাত দিয়েছেন। আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য চলছে। হরতাল, জ্বালাও পোড়াও হচ্ছে। এমন নৈরাজ্যকর অবস্থায় দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন। এভাবে চললে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে যাবে। দেশ বাঁচাতে কিছু মৌলিক ইস্যুতে সবাইকে ঐকমত্য হতে হবে। জাতীয় সংসদকেই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আমরা রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত হয়ে গেছি। কিন্তু দেশের স্বার্থের প্রশ্নে এক থাকতে হবে। প্রবীণ এ আইনজ্ঞ বলেন, বিশ্বজিৎ দাসকে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। এই বর্বরোচিত ঘটনার বিচারটিই এখন মুখ্য। অথচ হত্যাটি ছাত্রলীগ করেছে, নাকি জামায়াত-শিবির করেছে সেটি নিয়েই মাতামাতি হচ্ছে বেশি। এই হত্যায় জড়িতদের বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, ১৬ কোটি মানুষের এই দেশ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পুরনো চিন্তার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সফলতা যেমন আছে তেমনি ব্যর্থতাও আছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা সমুন্নত আছে, গণমাধ্যম সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করছে। এটি কম অর্জন নয়। শেয়ার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি এসব ঘটনার বিষয়ে সবিস্তারে জানতে পারছে মানুষ। ফলে মানুষের মনের মধ্যে একটা বিচার হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে যারা দুর্নীতি করবেন তাদেরও হুঁশিয়ার থাকতে হবে। সুপ্রিমকোর্ট বারের সাম্প্রতিক নির্বাচনের আগে বিরোধের কারণে আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ হেরে যাওয়ায় প্রেক্ষাপটে আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, স্বাধীনতার পর ৪১ বছর ধরে আমরা আইনজীবীদের মর্যাদার সংগঠন সুপ্রিমকোর্ট বারে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছি। আমরা সব সময় স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের প্রতি একাত্দ ছিলাম। সর্বশেষ নির্বাচনে এই সংগঠনে জামায়াত, বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এখন সেই বার কাউন্সিলে স্বাধীনতা বিরোধীদের তৎপরতা। এই বৈরী পরিবেশের মধ্যেও আমাদের আইনের শাসন সমুন্নত রাখা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার আন্দোলনে কাজ করে যেতে হবে।

সর্বশেষ খবর