বুধবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০১৩ ০০:০০ টা
মন্তব্য প্রতিবেদন

মশা মারতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কামান দাগা

পীর হাবিবুর রহমান

মশা মারতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কামান দাগা
রাজনীতিতে সমঝোতার সব দরজা-জানালা একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বিচারের মুখোমুখি। নিজের মাথার ওপরই নয়, নির্বাসিত পুত্রদের ওপরও মামলার খড়গ। রাজনীতির অন্দর মহলে জোর আলোচনা, খালেদা জিয়ার সামনে কারাবাস এমনকি নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাজনীতিতে একজন সৃজনশীল পরিশীলিত মার্জিত রুচির মানুষের ক্লিন ইমেজ নিয়ে বিচরণ করলেও এখন কারাগারে। তিনটি মামলায় জামিন হলেও ৩৯ মামলার আসামি মির্জা ফখরুল শীঘ্রই মুক্তি পাচ্ছেন, এমন আলামত দেখা যাচ্ছে না। ৩৭ মামলার গলার ফাঁস খোলা দূরে থাক, গতকাল নতুন দুটি মামলার আসামি হয়েছেন তিনি। এ মামলায় তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে ২০ দিনের রিমান্ড চেয়েছে পুলিশ। বেগম জিয়ার পাঁচ, বড় ছেলে তারেক রহমানের ১৪ ও ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মিলে জিয়া পরিবারের ওপর ২৫টি মামলার খড়গ ঝুলছে। এ কথা সত্য, আইন, বিধিবিধান ও সংবিধানের ঊর্ধ্বে কেউ নন। ক্ষমতায় যখন যারা থাকেন তখন জনগণ জানলেও তারা কেউ জানেন না তাদের আমলনামা। পরের সরকার এসে বিদায়ী ক্ষমতাসীনদের ওপর রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা, জেল,-জুলুম, নির্যাতনের থাবা বসালে মানুষও বিভ্রান্ত হয় কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা, তা নিয়ে। গত ২১ বছরে গণতন্ত্রের জমানায় দিনে দিনে রাজনীতি সহিংস ও প্রতিহিংসাপরায়ণ যেমন হয়েছে তেমনি সংসদকে নিষ্প্রাণ, অকার্যকর করে রাখার এক অদ্ভুত অসহনীয় প্রতিযোগিতা চলেছে। একই সঙ্গে প্রতিটি সরকার নিজের লোকদের বিভিন্ন মামলা ও অভিযোগ থেকে খালাস দিতে কার্পণ্য করেনি। স্বজনপ্রীতির রেসের ঘোড়া অব্যাহত গতিতে দৌড়াচ্ছে। দুর্নীতি, দলীয়করণ, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন রাজনীতিকে দিনে দিনে প্রশ্নবিদ্ধই করেনি, দূষিতও করেছে। রাজনীতিবিদদের সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড়ই করায়নি, ওয়ান-ইলেভেনের থাবা তাদের দেশত্যাগ, কারাবাসই দেয়নি, চরিত্রও হনন করেছে। তবুও ইতিহাসের বড় শিক্ষাই হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেননি। সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরের বিরুদ্ধে আরেক দফা ওয়ান-ইলেভেন আনার অভিযোগ তুলে পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের ঢোল বাজিয়ে চললেও কেউ স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেতনা নিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন না। ব্যবসাবান্ধব উদারনীতি গ্রহণ করেন না। যারা যখন ক্ষমতার সঙ্গী হন তারাই বিত্তবৈভরের মালিক হন। সরকারের চার বছর পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু নিয়ে কোনো কথা বলেননি। কথা বলেননি পদ্মা সেতু নিয়ে। বিরোধী দল ও তাদের দাবি-দাওয়া উপেক্ষা করে সরকার একতরফা নির্বাচনের পথেই হাঁটছে। অন্যদিকে, বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে দমন-পীড়নের মাধ্যমে হয় সমঝোতায় আনার কৌশল নিয়েছে অথবা তাদের বাইরে রেখে একটি নির্বাচন করে ফেলার অনড় অবস্থান নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহল ও দেশবাসী সবার অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণভাবে একটি জাতীয় নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে এলেও পর্যবেক্ষক মহল আগামী দিনের রাজনীতি সংঘাতময় হয়ে ওঠার চিত্রকল্প দেখছে। রাজনৈতিক আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এমন নাটকীয় কিছু ঘটার আভাস দেখা যাচ্ছে না যাতে করে বলা যাবে শেষ পর্যন্ত দুই দল একটি সমঝোতায় পৌঁছাবে। টানেলের শেষ প্রান্তে আলো দেখানোর আগ্রহ সরকার ও বিরোধী দলের কারোর মধ্যেই এখনো নেই। সংকটের মূল কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিরোধী দলের আসন গ্রহণের গণতান্ত্রিক চেতনা সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের মধ্যেই নির্বাসিত। প্রধানমন্ত্রী যতই বলুন, নির্বাচন হবে নিরপেক্ষ এবং গণরায় যা-ই হোক মেনে নেব। এমন কথা তখনই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় যখন একটি কার্যকর সংসদের মাধ্যমে জবাবদিহিতার পথে সরকার ও বিরোধী দল দায়িত্বশীল ভূমিকায় পরস্পরের প্রতি আস্থা নিয়ে অগ্রসর হয়। দেশে এখনো মানুষের মধ্যে তো নয়ই, প্রধান দুই রাজনৈতিক শাক্তি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউই বিশ্বাস করে না যে পরস্পরের দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। পঁচাত্তর-উত্তর সেনাশাসন জমানায় ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শাসকদের অধীনে এমন কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি যা গ্রহণযোগ্য ছিল। নব্বই-উত্তর প্রতিটি জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে বলে। সামরিক অভ্যুত্থানের পথে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পুনরায় গণরায় নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার সুবাদে। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি বিএনপি তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির আপত্তির মুখে, আন্দোলনকে গায়ে না মেখে তাদের আজ্ঞাবহ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচন করতে গিয়ে রাজনীতিকে সহিংস করে তুলেছিল। অবরুদ্ধ অশান্ত রক্তস্নাত বাংলাদেশে সেদিন ওয়ান-ইলেভেন এসেছিল ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে। সেই ওয়ান-ইলেভেন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেতনা হারিয়ে সেনাসমর্থিত সুশীলদের সরকার হয়ে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের ওপর অ্যাকশন চালিয়েছিল নির্বাচনের পথে না হেঁটে। সেদিন তারা সময়মতো নির্বাচন সম্পন্ন করলে এই বিতর্ক হতো না। তাই বলে সরকার ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়কের কালো মডেল দেখালে হবে না। ইতিহাসে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ ও বিচারপতি হাবিবুর রহমানের গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মডেল সামনে নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের পথে সমঝোতার উষ্ণ হাত বাড়িয়ে বিরোধী দলকে আস্থায় নিয়ে ফর্মুলা বের করতে হবে। দেশবরেণ্য মানুষদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সমঝোতার দুয়ার না খুলে সরকার ও বিরোধী দল যার যার অবস্থানে যদি অনড় থাকে আর গণতন্ত্রের ধারা ব্যাহত হয়, তাহলে রাজনীতিবিদদেরই দায় নিতে হবে। ইতিহাসের দায় কাঁধে নিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব যেমন রাজনৈতিক শক্তির তেমনি শান্তিপূর্ণ পথে নির্বাচনের মাধ্যমে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে সরকার ও বিরোধী দল উভয় পক্ষের জন্যই চ্যালেঞ্জের। এ দেশে দুই দলের ডাকে সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে। কিন্তু তারা বার বার ক্ষমতায় এসে মানুষের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারেনি। দুর্নীতি, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, সন্ত্রাস, জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণরায় নিয়ে এলেও নিজেরাই তা থেকে বের হতে পারেননি। গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বার বার তারা অবজ্ঞা, অবহেলা করলেও জনগণ তাদের প্রতি আস্থা প্রদর্শনে বার বার উদার নীতি গ্রহণ করেছে। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ফেরির চায়ের কাপ চুরির মামলা থেকে নানা মামলা দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে। তোফায়েল আহমেদের মতো দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদ ও পার্লামেন্টারিয়ানকে বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে সোজা জেলের ভাত খাওয়ানো হয়েছে। আজকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর থেকে বাহাউদ্দিন নাছিমদের ওপর রিমান্ড, জেল, নির্যাতন চালানো হয়েছিল। বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ওপর পরিচালিত ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার অপরাধীদের বিএনপি সরকার আড়াল করতে চেয়েছে। সেই সরকারের মন্ত্রী-নেতারা লাশের মিছিলের ওপর দাঁড়িয়ে দায়িত্বহীন কথাবার্তার সীমা ছাড়িয়েছিলেন। বিএনপি-জামায়াত সরকারের পাপের শাসনে টাইটানিকের মতো তাদের তরী ডুবেছিল ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে। মানুষের আশা ছিল প্রতিহিংসা, দলবাজি ও দুর্নীতির শাসনের অবসান। উদ্বিগ্ন দেশবাসী আজ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে প্রতিহিংসার রাজনীতিতে জেলমুক্তি হয় না বিএনপি মহাসচিবের। অদ্ভুত সব মামলার শিকার হন এহছানুল হক মিলন। জেলে আছেন দুলুরা। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির নায়করা ধরা পড়েন না। জনমতের চাপে ব্যাংক-ঋণ কেলেঙ্কারির নায়ক তানভীর আটক হয়েছেন। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বরপুত্রদের ধরা হচ্ছে। তবুও শিক্ষাঙ্গনে ভয়ঙ্কর মূর্তি নিয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, দুর্নীতির মহোৎসব, প্রশাসনের দলবাজি থামছে না। সরকার ব্যবসাবান্ধব না হয়ে কুইক রেন্টালের নামে কয়েকটি পরিবারের হাতে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দিয়েছে। নিজেদের রক্ষায় দায়মুক্তি আইন করেছে। যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর এই সে দিন সিপিবি-বাসদসহ নিরীহ আদর্শের রাজনীতির পথচলা বাম মোর্চা জনস্বার্থে হরতাল দিলে গর্ব নিয়ে বলেছিলেন তাদের হরতাল থেকে বিএনপির শিক্ষা নেওয়ার আছে। সেই শান্তিপূর্ণ হরতালকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতেও ভোলেননি। কিন্তু মাস যেতে না যেতেই বুধবারের একই দাবিতে আধা বেলার শান্তিপূর্ণ হরতাল শেষ হওয়ার কুড়ি মিনিট আগে ম খা আলমগীরের পুলিশ বাম মোর্চার মিছিলকারীদের ওপর মরিচের গুঁড়া ও লাল পানি ছুড়ে মেরেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাম দলের হরতালের নৈতিক ভিত্তি নেই। এ হরতাল ব্যর্থ হয়েছে। কোনো হরতাল হয়নি। হরতাল যদি ব্যর্থ হয়ে থাকে তাহলে মশা মারতে কামান দাগা কেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর? সিপিবি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়েছে। বিএনপি বাম মোর্চার হরতালে সমর্থন দেওয়ায় কি তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুলিশ হামলা চালাল? বাম মোর্চা প্রতিদিন হরতাল করলেই কি সরকার পতন সম্ভব? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুলিশ যদি পল্টন মোড়ে আয়েশের সঙ্গে চা পান করত আর বাম কর্মীরা মিছিল করত তাহলে কী এমন ঘটত? আসলে এ ধরনের ঘটনা না ঘটালে সরকার গণবিরোধী হয় না। সমালোচনার মুখে পড়ে না। আসলে এই রাজনীতি, শাসকের এই চেহারা মানুষের কাম্য নয়। অতীতে ছিল না। এখনো নয়। ভবিষ্যতেও নয়।

সর্বশেষ খবর