শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৩ ০০:০০ টা
ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের আঘাত

বিধ্বস্ত জনপদে হাহাকার

বিধ্বস্ত জনপদে হাহাকার
ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের আঘাতে লণ্ডভণ্ড দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জনজীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। তবে তাদের মধ্যে শঙ্কা রয়ে গেছে। স্থানীয় প্রশাসন তাদের পাশে দাঁড়ায়নি বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। অনেক উপকূলীয় এলাকায় এখনো ত্রাণসামগ্রী পেঁৗছায়নি। ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ফিরে অনেকে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ওষুধের সংকটের কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার মহাসেন ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে বহু ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদ বিধ্বস্ত হয়েছে। উপড়ে পড়েছে শত শত গাছপালা। গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে বহু ঘেরের মাছ। হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বিদ্যুৎ সংযোগ। যোগাযোগব্যবস্থা বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রাণহানি ঘটেছে ২০ জনের। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- চট্টগ্রাম : উপকূলবর্তী ছয় উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ের আগেই পাঠানো হয় নগদ টাকা ও শুকনো খাবার। কিন্তু বিধ্বস্ত এলাকার অনেকেই সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। ক্ষতিগ্রস্তরা সরকারি-বেসরকারি সহায়তার অপেক্ষা করছেন। তবে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস বলেছে, নগদ টাকা ও শুকনো খাবার এরই মধ্যে নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বিতরণ শুরু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে বাঁশখালী, আনোয়ারা, পটিয়া, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই ও সন্দ্বীপের ২৮ ইউনিয়নের ৫৪ হাজার ২৯৫ ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হন, বিধ্বস্ত হয় দুই হাজার ৫৫টি কাঁচা ঘরবাড়ি। এদিকে, শঙ্কা কাটছে না পতেঙ্গার সমুদ্র পাড়, বেড়িবাঁধসংলগ্ন এলাকার মানুষ ও ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের বাসিন্দাদের। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বেড়িবাঁধ যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে। বাগেরহাট : ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলের নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। গাছপালা উপড়ে পড়েছে ঘরবাড়ি ও ভবনের ওপর। প্রবল বর্ষণে ফসলের খেত-খামার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে রয়েছে। মংলা, রামপাল, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ উপজেলায় ২০০ কাঁচা ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। পুকুর ও জলাশয়ের পানিতে ভেসে গেছে সাদা মাছ। এখনো পানিবন্দী হয়ে রয়েছে শতাধিক পরিবার। পানি শোধনাগারগুলো (পন্ট সেন্ট ফিল্ডার) প্রায় পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব দেখা দিয়েছে বলে জানালেন ষাটোধর্্ব আবদুল মজিদ। গতকাল দুপুরে দেখা গেছে, শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সামনে অনেক ঘরবাড়ি জলাবদ্ধতার মধ্যে রয়েছে। উপজেলা ডাকঘরটি পানিবন্দী। বিভিন্ন ফসলের খেত পানিতে তলিয়ে রয়েছে। ধানসাগর গ্রামের কৃষক জব্বার বলেন, সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। তবে সিডর ও আইলা বিধ্বস্ত শরণখোলা উপজেলার মানুষের মাঝে এখনো যেন নতুন আতঙ্ক বিরাজ করছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম মামুনউজ্জামান জানান, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে। এদিকে পশুর নদের পাড়ের বাণীশান্তার অন্তত ২০০ যৌনকর্মী তিন দিন ধরে অভুক্ত। গতকাল বিকাল পর্যন্ত কোনো সংস্থাই এসব দুর্গত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। সন্ধ্যায় বৃষ্টি আর বাতাস শুরু হলে তারা প্রায় অভুক্ত অবস্থায় কয়েক কিলোমিটার দূরের সাইক্লোন শেল্টার আবার কেউ মংলা শহরে এসে আশ্রয় নেন। অধিকাংশই পল্লীতে ফিরে এলেও বিকাল পর্যন্ত কোনো খাবার জোটেনি। স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুল হালিম হাওলাদার জানান, সরকারিভাবে শুকনো খাবার সরবরাহের জন্য সাইক্লোন শেল্টারে যাওয়া হলেও সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি। লক্ষ্মীপুর : উপকূলীয় অঞ্চল লক্ষ্মীপুরে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে স্থানীয় প্রশাসন দাঁড়ায়নি বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। ভেঙে যাওয়া ও উড়িয়ে নেওয়া ঘরবাড়ি নিজেদের মেরামত করতে হচ্ছে বলে জানান তারা। গতকাল সরেজমিন চররমণীমোহন ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, চরমেঘাসহ কয়েকটি স্থানে ১৫-২০টি কাঁচা ঘর ভেঙে হেলে পড়ে আছে। কয়েকটি ঘর মহাসেনের আঘাতে তছনছ হয়ে পড়ে রয়েছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছেলেমেয়ে নিয়ে দিন এনে দিন খেতে তাদের কষ্ট হয়, তারা কীভাবে ঘর মেরামত করবেন_ তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। তারা অভিযোগ করেন, প্রশাসনের লোকসহ কেউই তাদের সহযোগিতা করেননি। একই অবস্থা বিরাজ রামগতি উপজেলার দ্বীপ এলাকার চরগজারিয়া, তেলীরচর ও বয়ারচরের। চররমণীমোহন ইউপি চেয়ারম্যান আবু ইউছুপ সৈয়াল জানান, নির্বাহী কর্মকর্তাকে ক্ষতিগ্রস্তদের কথা বলা হয়েছে, সহায়তা প্রদানে তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এদিকে মহাসেনের আঘাতে মেঘনার পানি স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে বেশি প্রবাহিত হয়ে এবং কয়েক দিনের টানা বর্ষণে এ অঞ্চলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এতে শত শত হেক্টর জমির সয়াবিন ও বাদাম চাষিরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখানকার অনেক চাষি সয়াবিন ও বাদাম চাষাবাদে ব্যাংক এবং দাদন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন এখন। ফসল ঘরে তুলে এসব ঋণ পরিশোধের কথা থাকলেও বর্তমানে নষ্ট হওয়া ফসলে তা কতটুকু সহায়ক হবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। জেলা প্রশাসক এ কে এম মিজানুর রহমান জানান, তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে তাদের ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হবে। বরিশাল : বিশাল অংশ ধসে গেছে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের বাবুগঞ্জ অংশে থাকা বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (দোয়ারিকা) ও মেজর জলিল (শিকারপুর) টুইন সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়কের। উভয় সেতুর পূর্ব প্রান্তে ৫০ মিটার করে প্রায় ১০০ মিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক ধসে পড়ায় ফের ভারী বৃষ্টিপাত হলে যে কোনো সময় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ভারী বর্ষণ ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে বরিশালের ছয় জেলায় চার লাখ ৫৪ হাজার ৮৭৩ হেক্টর জমির মধ্যে এক লাখ ৮২ হাজার ৬০৪ হেক্টরের ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তা গাজী হারুন অর রশিদ জানান, কিছু ফসলের ক্ষতি হতে পারে। তবে তা ব্যাপক হবে না। ঘূর্ণিঝড়ে বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরাদি, চরামদ্দি, নলুয়া, দাঁড়িয়াল, দুর্গাপাশা, রঙ্গশ্রী, ভরপাশা, ফরিদপুর ও পৌর এলাকাসহ প্রায় সব কটি ইউনিয়ন, পৌর এলাকার ৫০টি, চরাদি ইউনিয়নের ৬৫টি, ভরপাশা ইউনিয়নের ৫০টি, দুর্গাপাশা ইউনিয়নের ৬০টি, নলুয়া ইউনিয়নের ৭০টি, দাঁড়িয়াল ইউনিয়নের ৭৫টি কাঁচা ও আধা পাকা ঘর, ফরিদপুর ইউনিয়নের পূর্ব ভাতশালা কারিকরনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের মুনির উদ্দিন আহম্মদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাদ্রিশিবপুর ইউনিয়নের আমেনা খাতুন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ পাঁচটি বিদ্যালয় এবং ১৪টি ইউনিয়নের সহস াধিক কাঁচা ও আধা পাকা ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া শতাধিক মাছের ঘের, কয়েক সহস াধিক গাছপালা ভেঙে বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। ভোলা : কয়েক হাজার পরিবার গতকালও খোলা আকাশের নিচে ছিল। চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলার বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে মানুষের দুর্ভোগ চরমে। দুর্গম চরগুলোর অনেকেই ত্রাণসহায়তা পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর দিন ভোলার উপকূলীয় এলাকায় আবহাওয়া স্বাভাবিক হয়ে এলেও বিভিন্ন চরে রয়ে গেছে ঝড়ের ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। চরফ্যাশনের তেঁতুলিয়া নদীর মধ্যবর্তী মুজিবনগর ইউনিয়নের শিকদার চরে শতাধিক পরিবারের নারী-শিশুরা চরের একমাত্র মাটির কিল্লার ওপর অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন শিকদার চরের মেম্বার আবদুল মালেক। চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুর-ই আলম জানান, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদের অনুকূলে চাল ছাড় করা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় কোটি টাকার পানের বরজ নষ্ট হয়ে পড়েছে। বরজ বিধ্বস্ত হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কয়েক শ পান চাষি। পটুয়াখালী : জনজীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। মানুষ কর্মস্থলে যেতে শুরু করেছে। ঝড়ে উপড়ে পড়া গাছপালা অপসারণ করে সড়ক যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ সংযোগ চালুর কাজ চলছে। পটুয়াখালী-কুয়াকাটা সড়কের হাজিপুর ও কলাপাড়া ফেরির পন্টুন ঝড়ের আঘাতে ডুবে যাওয়ায় কলাপাড়া-কুয়াকাটা সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এ সড়কে যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। সূর্যমুখী, মরিচ, বাদামসহ রবি ফসল গাছপালার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। কঙ্বাজার : জেলার তিন উপজেলার ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে। আশ্রয় নেওয়া মানুষ বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে। বরগুনা : জেলার আমতলী-পুরাকাটা ও কাকচিড়া-বড়ইতলা রুটের ফেরি যোগাযোগসহ পুরো জেলায় এখনো বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে।

সর্বশেষ খবর