বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৩ ০০:০০ টা

সরকারের অবস্থানে দ্বিধায় কূটনীতিকরা

বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংলাপ ও অন্যান্য বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে নিজেদের দ্বিধার কথা জানিয়েছেন ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকরা। গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে সরকারের স্পষ্ট অবস্থান সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির কাছে জানতে চান তারা। উত্তরে সরকার আলোচনার বিষয়ে আন্তরিক বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অন্যদিকে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কোনো কোনো কূটনীতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করছেন বলে অভিযোগ করেন ডা. দীপু মনি। গতকাল চলমান পরিস্থিতি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে ব্রিফিং শেষে সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেন তিনি। সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মোজেনা বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে কথা বলতে ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লি যান। এ প্রসঙ্গে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে দীপু মনি জানান, সব রাষ্ট্রদূতই কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করছেন না, কেউ কেউ করছেন। যে কোনো বিষয় নিয়ে কূটনীতিকরা তাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো বিষয় নিয়ে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত নয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ওই ব্রিফিংয়ে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ভারত, সৌদি আরব, আফগানিস্তান, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, উরুগুয়ে, ইরান, ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনারসহ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউএনডিপি ও জাতিসংঘের বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন দূতাবাস, উন্নয়ন সহযোগী ও আন্তর্জাতিক সংস্থা মিলিয়ে প্রায় ৬০ জন কূটনীতিক এতে অংশ নেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারের মেয়াদ, পার্লামেন্টের মেয়াদ, নির্বাচনপূর্ব পরিস্থিতি এবং অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের পর বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া ও সহিংসতা এবং 'কী হবে ভবিষ্যতে' এই শিরোনামে বক্তব্য দেন।

কূটনীতিকদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটি সংকটপূর্ণ মোড়ে (ক্রিটিক্যাল জাঙ্কচার) এসে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় নানা ধরনের গুঞ্জনও ছড়ানো হচ্ছে। দীপু মনি বলেন, আগামী বছরের শুরুতেই একটি গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনই বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। তিনি বলেন, আপনাদের মতোই আমরাও আশা করি, আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক একটি সমাধানে পেঁৗছানো যাবে। তিনি আরও বলেন, আলোচনা ও সমাধান নিয়ে আমাদের সরকারের কোনো বাকচাতুর্যতা নেই; কেউ যদি তা করে থাকেন তবে তা হবে অসদুদ্দেশ্যের কাজ।

সরকারের মেয়াদ সম্পর্কে দীপু মনি কূটনীতিকদের বলেন, ২৭ অক্টোবর সরকারের মেয়াদ শেষ হয়েছে বলে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছিল। তিনি এ প্রসঙ্গে সংবিধানের ৫৭ ও ৫৮ ধারা কূটনীতিকদের ব্যাখ্যা করে বলেন, পরবর্তী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর হাতেই শেখ হাসিনা দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন। তবে তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারি চলমান সংসদ এমনিতেই ভেঙে যাবে। সেই ২৪ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। তিনি বলেন, ৪০-৪৫ দিনের সময় নিয়ে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। দীপু মনি বলেন, জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করেই সব কিছু বলেছেন। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বিরোধী দলকে নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নেওয়ারও আমন্ত্রণ জানান। বিরোধী দল অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এরপর বিরোধীদলীয় নেতা এমন একটি প্রস্তাব দিলেন, যা সংবিধানসম্মত নয়। তিনি আলোচনার জন্য সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার সময় দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন সত্ত্বেও ৬০ ঘণ্টার হরতাল দিলেন। তিন দিনের হরতালে সারা দেশে ১১ জনের প্রাণহানি হলো। বিচারপতি, নির্বাচন কমিশনার, মন্ত্রীদের বাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে বোমাবাজি করা হলো। শুধু তাই নয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে দণ্ডিত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার বাদী ও সাক্ষীর বাড়িতেও হামলা হলো। গণমাধ্যমও তাদের হামলার হাত থেকে বাঁচল না। এর পরও প্রধানমন্ত্রী চান আলোচনা করতে; আমরা চাই আলোচনা সফল হোক, একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান আসুক। স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের দ্বারা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানান তিনি।

কূটনীতিকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতা শেষে সভাকক্ষের বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন দীপু মনি। ব্রিফিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে আমাদের দেশে কর্মরত কোনো কোনো কূটনীতিক উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকেন। পাশাপাশি তারা আগামী নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার আহবান জানিয়ে আসছেন। আলোচনার জন্য সরকার সব সময় প্রস্তুত রয়েছে বলে আমরা কূটনীতিকদের জানিয়ে দিয়েছি। তারা হরতাল-সহিংসতা আর প্রাণহানির ঘটনা নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও সংলাপের ব্যাপারে এখনো আশাবাদী বলে আমাদের জানিয়েছেন। কূটনীতিকরা মনে করেন, বাংলাদেশে চলমান পরিস্থিতির উত্তরণে দেশের রাজনীতিকরা উদ্যোগ নেবেন এবং একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সমঝোতায় আসতে পারবেন। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে দীপু মনি বলেন, 'সব রাষ্ট্রদূতই কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করছেন না, কেউ কেউ করছেন। যে কোনো বিষয় নিয়ে কূটনীতিকরা তাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো বিষয় নিয়ে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত নয়।'

 

 

সর্বশেষ খবর