শিরোনাম
শনিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৪ ০০:০০ টা

কারাগারে ঠাঁই নেই

মানবিক বিপর্যয়ের আশংকা, চলছেই গণগ্রেফতার

কারাগারে ঠাঁই নেই

ঠাঁই নেই দেশের কারাগারগুলোতে। রাজনৈতিক ধরপাকড় আর গণগ্রেফতারের কারণে বন্দীতে ঠাসা হয়ে উঠেছে কারাগারগুলো। নিত্য নতুন বন্দীদের ভারে রীতিমতো উপচে পড়ছে দেশের ৬৮টি কারাগার। ধারণক্ষমতা ২৯ হাজার হলেও বর্তমানে সেখানে রয়েছেন ৭০ হাজারেরও বেশি বন্দী। আড়াইগুণ বেশি বন্দী সামাল দিতে বেসামাল হয়ে পড়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। এর সঙ্গে দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। তীব্র শীতে কারা অভ্যন্তরে বন্দীদের দুর্দশা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে। চিকিৎসাও মিলছে না যথাযথ। মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে কারাভ্যন্তরে। 
সূত্র জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ধারণ ক্ষমতা মাত্র ২৬৮২ জন। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীর সংখ্যা ছিল ৭৪৮২ জন। গতকাল ২০০ জন বন্দী কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে। জামিন পেয়েছে ১০২ জন বন্দী। 
সংশ্লিষ্টরা বলছে, এক মাস ধরে সারা দেশে ধরপাকড় ও গ্রেফতারের মাত্রা বেড়ে যায় এবং বন্দীদের বেশির ভাগই বিরোধী দলের নেতা-কর্মী। দেশের কারাগারগুলোর নির্ধারিত সেলগুলোতে ঠাঁই হচ্ছে না এসব বন্দীর। ফলে বাধ্য হয়ে কারা কর্তৃপক্ষ কারাভ্যন্তরের বিভিন্ন গোডাউন, বড় সেলের বারান্দা, এমনকি যেসব সেলের বাথরুমগুলো বড়, সেগুলোকেও পরিবর্তন করে সেল বানানো হয়েছে। এর পরও গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে বন্দীদের। মাঝে মাঝে এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে বন্দীদের অদল-বদল করে ভারসাম্য রক্ষা করা হচ্ছে। বন্দীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকলে কারাগারের ভেতরে পরিবেশ অস্থির হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন তারা। 
জানা গেছে, ছোট বড় ৬৮টি কারাগার রয়েছে সারা দেশে। এর মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও দুটি হাই সিকিউরিটি সেল। ৫৫টি বিভিন্ন জেলা সদরে রয়েছে ছোট কারাগার। এসব কারাগারে রাজনৈতিক বন্দীদের সংখ্যাই বেশি। ৭০ হাজার বন্দীর মধ্যে অর্ধেকই বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দীদের অনুমোদিত ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ৮৩ জনের। সেখানে বর্তমানে আছে ৯৮৯ জন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল এক কারা কর্মকর্তা জানান, প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ জন বন্দী তারা গ্রহণ করেন। বন্দী গ্রহণের সংখ্যা বেশি হলেও জামিনের হার অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় কম। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত জামিন ছিল না বললেই চলে। তার বক্তব্যের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদের বক্তব্যেও। তিনি বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, গত কয়েক দিনে প্রায় ১২০০ সন্ত্রাসীকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও দুই হাজার সন্ত্রাসী আটক করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। কারা অধিদফতরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা গত রাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বন্দীর সংখ্যা কি পরিমাণ বেড়েছে তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে জামিনে মুক্তি পাওয়া বন্দীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। কারাগারের গেট থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া বন্দী গ্রেফতারের সংখ্যা ইদানীং বেড়েছে। তবে এটা একান্তই পুলিশ বিভাগের কাজ, তাই এ ব্যাপারে আর কোনো মন্তব্য না করে তিনি আরও বলেন, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মহিলা কারাগারসহ ৬৮ কারাগারে বন্দীর সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার রয়েছে। তবে বন্দীর সংখ্যা বেশির বিষয়টি অস্বীকার করেন কারা উপ-মহাপরিদর্শক গোলাম হায়দার। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বন্দী এখন কম। বর্তমানে দেশের ৬৮টি কারাগারে ৬৬ হাজারের মতো বন্দী রয়েছে। এসব বন্দী ব্যবস্থাপনা করতে আমাদের তেমন একটা সমস্যা হচ্ছে না। বিএনপি সূত্রে দাবি করা হয়, বিগত ৪৭ মাসে তাদের ২০ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী গ্রেফতার হন। মামলার পরিমাণও শত শত। এ ছাড়া অন্যান্য দলের কয়েকশ নেতা-কর্মীও গ্রেফতারের শিকার হয়ে কারাবন্দী হন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর হিসাব মতে, গত ৪৭ মাসে দলটির ২১ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী গ্রেফতারের শিকার হন। দেড় হাজার মামলায় তাদের দলের দুই লাখের অধিক নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়।
'পেন্ডিং মামলা' : এদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে লাগামহীন বাণিজ্যে মজেছেন কারাগারের ও পুলিশ বিভাগের কতিপয় দুর্নীতিবাজ সদস্য। জামিন নিয়েও রেহাই মিলছে না বন্দীদের। 'পেন্ডিং মামলা' আতঙ্ক দিয়ে তাদের কাছ থেকে আদায় করে নেওয়া হচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের অধিকাংশ কারাগারে 'পেন্ডিং মামলা' আতঙ্কে ভুগছেন জামিনে মুক্তি পাওয়া বন্দীরা। গত এক সপ্তাহে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে সংশ্লিষ্ট থানার সিভিল টিম দুর্নীতিগ্রস্ত কারা কর্মচারীর যোগসাজশে জামিনপ্রাপ্ত বন্দীদের আবার আটক করে সাজানো পুরনো ভাঙচুর, আগুন, বিস্ফোরক দ্রব্যসহ নানা অভিযোগে মামলায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে ওই সিন্ডিকেটের দাবি অনুযায়ী টাকা দিতে পারলে সেক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সম্প্রতি বাড্ডা থানার একটি মামলার আসামি আবদুল হাফিজ (ছদ্মনাম) এক সপ্তাহ ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ রয়েছেন। কারা কর্তৃপক্ষ তাকে বর্তমানে যমুনা চার সেলে রেখেছে। তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারাগারে নেওয়ার পর প্রথম দুই রাত এক দিন বিনিদ্র রজনী কাটে। দুই বেলা খাবারও তাকে দেওয়া হয়নি। পরে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে মিয়া সাব মাসুদের দাবিকৃত সাত হাজার টাকা নিয়ে দেওয়ার পর কিছুটা শান্তি আসে। দুই সপ্তাহ আগে রাজধানীর শ্যামপুর থেকে রাসেলকে (ছদ্মনাম) ধরে নিয়ে যায় শ্যামপুর থানা সিভিল টিম। তার অবস্থাও অনেকটা একই। প্রতি সপ্তাহে ৩৬০০ টাকা দিতে হচ্ছে তার পরিবারের সদস্যদের। গতকাল আবার মিয়াসাবকে টাকার দেওয়ার কথা ছিল রাসেলের। তবে পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে টাকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। কারাগারের সাক্ষাৎ কক্ষে তার ভাইকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। পরে রাসেলের ভাইয়ের সঙ্গে এ প্রতিবেদক কথা বলার একপর্যায়ে তিনিও কেঁদে ওঠেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, 'টাকা না দিলে খুব নির্যাতন করে কারারক্ষী, মিয়াসাবরা (রাইটার)। আইজকা নিশ্চিত আমার ভাইকে টেহার লাইগ্যা মারবো। আমি নিজে অন্যের দোকানের কর্মচারী। এহন কই থাইক্যা টাকা দিমু?' তিনি আরও জানান, যমুনা-৪ সেলে তার ভাইয়ের একটি সিটে তিনজন বন্দী থাকছেন। হাড়কাঁপা শীতে পাতলা কাপড়ের মতো একটি কম্বলে তিনজনকে থাকতে হচ্ছে। এ নিয়ে কোনো কথা বললেই ওই বন্দীর ওপর নেমে আসছে ভয়ানক নির্যাতনের খড়গ। কুমিল্লা কারাগারের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কারাগারের ভেতরের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। প্রতিদিন শত শত লোককে পুলিশ ধরে কারাগারে প্রেরণ করছে। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে তখন বন্দীদের আমরা কোথায় রাখব তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।

সর্বশেষ খবর