শিরোনাম
শনিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৪ ০০:০০ টা

সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নেই

সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নেই

সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নেই বলে মন্তব্য করা হয়েছে লন্ডনভিত্তিক প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে। 'প্রহসনের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার পরিকল্পনা করছেন' শিরোনামের এ প্রতিবেদনটি আজ প্রকাশিতব্য ইকোনমিস্টের নতুন সংখ্যায় আছে। তবে প্রতিবেদনটি গতকালই অনলাইন সংস্করণে তুলে দেওয়া হয়েছে। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনটি প্রায় হুবহু প্রকাশ করা হলো- বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নৈরাশ্যজনকভাবে একজন সু-অভিনেত্রী নাকি রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন তা বোঝা কঠিন হয়ে পড়ছে। রাজধানী ঢাকায় সাংবাদিকদের সামনে স্মিত হেসে বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করায় তিনি তাদের এ ভুলের জন্য তিরস্কার করেন। তার জয়ের বৈধতার বিষয়ে যে সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে, তাও পাশ কাটিয়ে যান। যে কোনোভাবেই তার দেশের গণতন্ত্র অতিশয় খারাপ অবস্থায় রয়েছে। ৯ কোটি ২০ লাখ সম্ভাব্য ভোটারের মধ্যে (১৫ কোটির বেশি জনসংখ্যার মধ্যে) ভোট পড়েছে খুব সামান্যই। সরকার বলছে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। তবে অন্যরা বলছে খুব কম। আর এ ফলাফল ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে দ্বিতীয় মেয়াদের বৈধতা দিতে পারে না। বহু ভোট কেন্দ্রে তেমন ভোটারই দেখা যায়নি। কিন্তু দিনের শেষে দেখা যায় সন্দেহজনকভাবে বিপুলসংখ্যক ভোট পড়েছে। ৩০০ আসনের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি, ১৫৩টিতে কোনো নির্বাচনই হয়নি। এসব আসনে শুধু আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররাই জয়ী হয়েছে। রাজধানীর ২০টি আসনের মধ্যে ভোট হয়েছে মাত্র ৯টিতে।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও ছোটখাটো বেশ কিছু দল ভোটে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা বলেছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে, তা নিরপেক্ষ হবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা ২০১১ সালে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টির নেতা, সাবেক সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সামরিক হাসপাতালে আটকে রাখা হয়। কারণ এরশাদও শেষ দিকে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছিলেন। মাত্রাতিরিক্ত ধর্মীয় মনোভাবের কারণে নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় চতুর্থ দল জামায়াতে ইসলামী। ৭ জানুয়ারি বিরোধী দলের আরও বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে খালেদা জিয়ার একজন বিশ্বস্ত উপদেষ্টাও রয়েছেন। হাজার হাজার কর্মী-সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়। রাজনৈতিক ত্রাসকে সরকারিভাবে সহিংসতা বন্ধের প্রচেষ্টা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয় পাওয়ার পর তা চলতে থাকে।

শুধু ভোটের দিনই আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংঘাত এবং ভোট দিতে নিরুৎসাহিত করতে বিরোধী দলের বাসে পেট্রলবোমা বিস্ফোরণের মতো অব্যাহত ঘটনায় ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে সহিংস আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। সব মিলিয়ে রক্তাক্ত কদর্যতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নতুন একটি বছরের শুরু হলো। ২০১৩ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় অনেক মানুষ নিহত হয়, যা স্বাধীনতার পর সবচেয়ে সহিংস বছরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ক্ষেত্রবিশেষে সরকার এ জন্য দায়ী করেছে বিএনপিকে, বিশেষ করে এর ইসলামী জোটকে। নির্বাচনের পর তৃণমূল পর্যায়ের সংখ্যালঘুদের ওপর জামায়াতি দস্যুদের হামলার অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য আওয়ামী লীগও এ অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী। যুদ্ধাপরাধের ত্রুটিপূর্ণ বিচারব্যবস্থা, যার মাধ্যমে ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধে বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে, এতে উত্তেজনা ভীষণভাবে বেড়েছে। বিচার ও রায় কার্যকর বেশ কয়েক মাস ধরে চলবে।

শেখ হাসিনা কত দিন পর্যন্ত তা চালিয়ে যেতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেন, তা পরিষ্কার নয়। বিদেশি রাষ্ট্রগুলো নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের জন্য চাপ প্রয়োগ করবে। তবে তা দৃঢ়ভাবে নয়। পশ্চিম রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছিল। ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশের সরকার নির্বাচনকালীন সহিংসতা ও ত্রুটিযুক্ত নির্বাচনের ব্যাপারে হতাশা ব্যক্ত করেছে। কিন্তু কোনো রাষ্ট্রই বলেনি যে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিজয় অবৈধ। বিদেশিরা বাংলাদেশে সহযোগিতা বা বাণিজ্যসুবিধা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিতে পারে (বিশেষ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার রয়েছে)। কিন্তু বাংলাদেশে দারিদ্র্য দূরীকরণে প্রশংসনীয় যে অবদান তারা রাখছে, তা খাটো করে দেখার ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করবে তারা। তাই শেখ হাসিনা মনে করেন, তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পারবেন। শেখ হাসিনা যদি বেগম খালেদা জিয়াকে প্রস্তাব দেন, তবে তা তার সময় ক্ষেপণের জন্য যথেষ্ট হতে পারে। সরকারি পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নির্বাচনের প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে। কিন্তু এ বিষয়গুলোয় সমঝোতায় পৌঁছাতে বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত লেগে যাবে ও হয়তো কখনই সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে না। এদিকে, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বিএনপিকে প্রবল চাপ প্রয়োগ করবে সরকার।

শেখ হাসিনা আসলে একধরনের রাজনৈতিক আচ্ছাদনে আছেন, বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের রাজনৈতিক সমর্থন পাচ্ছেন। নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছিল ভারত এবং নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রশংসাও করেছিল। আগে ভারত চেষ্টা করেছিল প্রধান দুটি দলের প্রতিই দেশটির মনোভাব একই তা প্রদর্শন করতে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এখন ধারণা করছে, প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় ভারতের অনেক বেশি সুনজরে রয়েছেন হাসিনা। এটা সুস্পষ্ট যে জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামী দলগুলোকে দুর্বল দেখতে চায় ভারত।

২০০৭ সালে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে একই সঙ্গে নির্বাসনে পাঠানোর যে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল, তেমনটা ঘটবে বলে মনে হয় না। ২০০৭-০৮ মেয়াদে সেনাবাহিনী বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। এদিকে, শেখ হাসিনা সশস্ত্র বাহিনীকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর লোভনীয় দায়িত্ব এবং রাশিয়া থেকে অস্ত্র ও চীন থেকে সাবমেরিন আমদানির প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে মধুর সম্পর্ক সৃষ্টি করেছিলেন, তা থেকে ফায়দা পাচ্ছেন। এর ফলে আসন্ন মাসগুলোয় ব্যারাকেই থাকতে সেনাদের উৎসাহিত করবে।

আসলে বিতর্কিত নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে নতুন আরেকটি নির্বাচন এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ বিরোধী দল করতে পারবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে শেখ হাসিনাকে একজন 'স্বৈরশাসক' হিসেবে অভিহিত করেন বেগম খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া মনে করছেন তিনি (হাসিনা) 'কখনই ক্ষমতা ছাড়বেন না'। তার পরও সব কিছুই যদি ভালো ভালোই চলে, তবে সেই অনুমান ভুল প্রমাণ হতেও মাসের পর মাস লেগে যেতে পারে।

 

 

সর্বশেষ খবর