বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ০০:০০ টা
শাস্তির বদলে পুরস্কার

বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যর্থ ওরিয়ন গ্রুপ

আগের তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে কোনোই অগ্রগতি নেই। এখন পর্যন্ত অর্থায়নই চূড়ান্ত করা হয়নি। অথচ নতুন করে আরও তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেওয়া হচ্ছে অনভিজ্ঞ ওরিয়ন গ্রুপকে। এর ফলে ২০২১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ভিশন দেখাচ্ছে আওয়ামী লীগ, তা ব্যাহত হতে পারে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা। বাংলানিউজ-টোয়েন্টিফোর.কম।ওরিয়ন গ্রুপকে আগে যে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সেগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৮৬ মেগাওয়াট। আর নতুন করে যে তিনটির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে সেগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ১ হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট। নতুন তিনটি পেলে তাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়াবে ২ হাজার ২৮০ মেগাওয়াট। ২০১২ সালের ২৭ জুনে প্রথম বেসরকারি মালিকানাধীন তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি করে সরকার। এগুলো হচ্ছে মাওয়া ৫২২ মেগাওয়াট, খুলনা ২৮২ ও চট্টগ্রাম ২৮২ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সবগুলোরই অনুমোদন দেওয়া হয় বিদ্যুৎ খাতের একেবারেই নবীন কোম্পানি ওরিয়নকে। ওরিয়নের সঙ্গে পার্টনার হিসেবে রয়েছে চাইনিজ কোম্পানি লনকিং। অনভিজ্ঞ একটি কোম্পানিকে একসঙ্গে এতগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দিতে আপত্তি জানিয়েছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টার বিশেষ উৎসাহের কারণে বিদ্যুৎ বিভাগের আপত্তি কোনো কাজে আসেনি।

আগের তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি মাওয়া ৪৫ মাস এবং অন্য দুটি ৩৬ মাসের মধ্যে উৎপাদনে যাওয়ার কথা। কিন্তু ১৯ মাস পার হয়ে গেলেও এখনো অর্থায়ন নিশ্চিত করতে পারেনি কোম্পানিটি।

নিয়ম রয়েছে অর্থায়ন নিশ্চিত করার পর চুক্তি সম্পাদন হবে। অর্থায়নের বিষয়ে সরকার বা বিদ্যুৎ বিভাগের কোনো রকম দায় থাকে না। সংশ্লিষ্ট কোম্পানি যদি যথাসময়ে কাজ শুরু করতে না পারে তাহলে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে কোনো রকম আপত্তি গ্রাহ্য হবে না। সরকারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের ১২০ দিনের মধ্যে অর্থায়নকারীর সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

কিন্তু ওরিয়ন গ্রুপ এখন পর্যন্ত নানা রকম তথ্য দিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগকে বিভ্রান্ত করে কালক্ষেপণ করছে। বিদ্যুৎ বিভাগ অগ্রগতির কথা জানতে চাইলে তারা একেক সময় একেক রকম তথ্য দিচ্ছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। আগের তিনটির ক্ষেত্রে যখন পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে কোম্পানিটি, সেখানে নতুন করে আরও তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের দায়িত্ব দিতে যাচ্ছে সরকার। এ তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে ঢাকা-২৮২ মেগাওয়াট, চট্টগ্রাম ২৮২ ও ঢাকা ৬৩৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর অনুমোদন দিয়েছে প্রকল্প তিনটি। আর ৩১ অক্টোবর আগ্রহপত্র (এলওআই) ইস্যু করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে আইপিপি সেল-১ এর পরিচালক গোলাম কিবরিয়া জানিয়েছেন। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বৃহৎ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্টের দেখভাল করার দায়িত্বে রয়েছে এই আইপিপি সেল-১। ওরিয়ন গ্রুপ বিদ্যুৎ খাতে একেবারেই নতুন। তাদের এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। শুধু মেঘনাঘাটে ১০০ মেগাওয়াট একটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে সংস্থাটির। আর সিদ্ধিরগঞ্জে অপর একটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের শেয়ার কিনেছে ওরিয়ন। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন পুরোপুরি ভিন্ন বিষয়। কারণ কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র রেডিমেড ভাড়া পাওয়া যায়। অবকাঠামো নির্মাণ শেষে মেশিন বসিয়ে দিলেই হয়ে যায়। কিন্তু নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। ওরিয়ন গ্রুপকে এতগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের দায়িত্ব দেওয়ায় পরোক্ষভাবে বিদ্যুৎ বিভাগও জিম্মি হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। ওরিয়ন গ্রুপ শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, কোম্পানিটি এর আগে ২০১০ সালে পিপিপির আওতায় চট্টগ্রাম ইস্টার্ন রিফাইনারির (দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগার) শোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ থেকে ৪৫ লাখে উন্নীতকরণ প্রকল্প গ্রহণ করে। ওই সময় ওরিয়ন গ্রুপ ব্রিটিশ ফস্টার হুইলারের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তারা দফায় দফায় সময় নিয়েও অর্থায়ন করতে ব্যর্থ হয়। ওরিয়ন সে সময়ে ব্রিটিশ একটি ব্যাংক অর্থায়ন করবে বলে নিশ্চিত করেছিল।

কিন্তু পরে বিপিসি ব্রিটিশ দূতাবাসের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জেনেছে, ওই ব্যাংকের অর্থায়ন করার মতো সক্ষমতা আদৌ নেই। পরে বাধ্য হয়ে প্রকল্পটি বাতিল করেছে বিপিসি। পরিশোধিত তেল আমদানির চেয়ে অপরিশোধিত তেল আমদানি করলে প্রতি লিটারে সাশ্রয় হয় প্রায় ৬ থেকে ৮ টাকা। ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে সামান্য পরিমাণ পরিশোধিত তেল আমদানির প্রয়োজন পড়ত। যাতে করে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হতো বিপিসির। অনেকে মনে করেন, বিপিসি মুনাফায় যেতে পারত। কিন্তু শুধু ওরিয়ন গ্রুপের খামখেয়ালির কারণে সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি পিছিয়ে গেছে। তারপরও সেই ওরিয়ন গ্রুপকে কেন এতগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হলো তার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আইপিপি সেল-১ এর পরিচালক গোলাম কিবরিয়া জানান, প্রথম দফায় দেওয়া তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে চট্টগ্রামের কেন্দ্রটি স্থানান্তর করে খুলনার লবণচরায় করতে চায় ওরিয়ন। তাদের সেই প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওরিয়ন গ্রুপ অর্থ জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়েছে। যে কারণে যথাসময়ে আর আসতে পারছে না বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। প্রকল্প সাইটে মাটি ভরাটের কাজ চলছে বলেও দাবি করেন গোলাম কিবরিয়া। আগেরগুলো স্থাপনে ব্যর্থ হওয়ার পরও একটি কোম্পানিকে আবারও তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র দেওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের। এ সম্পর্কে আমার কোনো মন্তব্য নেই। অনেকবার চেষ্টা করেও ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিমের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তার মোবাইল ফোনে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, বিষয়গুলো বিগত সরকারের সময়ে হয়েছে। সব কিছুর খবর নেওয়া হচ্ছে। কোনো কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে না। কেউ ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর